গত মাসে ভয়াবহ ভূমিকম্পের আঘাতে কেঁপে ওঠে মিয়ানমার। ২৮ মার্চের দুর্যোগে মারা গেছেন কয়েক হাজার মানুষ। ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কারণে ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির বিষয়টি কিছুটা যেন আড়ালেই পড়ে আছে।
মিয়ানমারজুড়ে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রতিকৃতি, আকাশচুম্বী উপাসনালয়, শ্বেতশুভ্র প্যাগোডা। সাত দশমিক সাত মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে বার্মিজ জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্রতার প্রতীক এসব স্থাপনার বেশিরভাগই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ভূমিকম্পে মুখ থুবড়ে পড়েছে নাগায়ো প্যাগোডায় বুদ্ধকে নিরাপত্তা দেওয়া পবিত্র সরীসৃপের মাথা। কিংবদন্তি অনুযায়ী, বোধিলাভের পর বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে বুদ্ধকে রক্ষা করেছিল এই সরীসৃপ।
প্রায় দুইশত বছরের পুরোনো এই প্যাগোডায় নিয়মিত প্রার্থনা করতে আসতেন খিন সেইন। ভূমিকম্পের সময় প্যাগোডার আধ্যাত্মিক রক্ষাকর্তার কাছে নিরাপত্তা চান ৮৩ বছর বয়সী সেইন। তবে তার ছেলে জানায়, প্যাগোডা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার জানিয়েছে, ভূমিকম্পের আঘাতে তিন হাজারের বেশি মনাস্টেরি এবং পাঁচ হাজারের বেশি প্যাগোডা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রের চারপাশে অবস্থিত প্রাচীন শহর মান্ডালে, সাগাইন ও ইনওয়া এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এগুলো সবই বার্মিজ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
১৮৮৫ সালে ম্যান্ডালেতে মিয়ানমারের শেষ রাজাকে বন্দি করে ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা করে ব্রিটিশরা। আজ সেই প্রাচীন রাজপ্রাসাদের কারুকাজ করা প্রাচীর ভেঙে পড়েছে, বহু সৌধ ধসে পড়েছে।
সাগাইনের দিকে একটি এক কিলোমিটার দীর্ঘ ঔপনিবেশিক আমলের একটি সেতু ইরাবতী নদীতে ভেঙে পড়েছে। যেখানে একসময় অসংখ্য আকাশচুম্বী প্যাগোডা ও উপাসনালয় ছিল, সেগুলোর অনেক কিছুই এখন ভগ্নদশায় বা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন।
১৮৩৯ সালে আট দশমিক দুই মাত্রার ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে প্রায় ৩৬০ বছর রাজধানীর মর্যাদা ভোগ করেছে ইনওয়া। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, গত মাসের ভূমিকম্পে ইনওয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তিন-চতুর্থাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে।
৪৯ বছর বয়সী সন্ন্যাসী থু নন্দ বলেছেন, প্রাচীন কীর্তি অমূল্য সম্পদ। ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষতি মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।
এগুলো সংস্কার করা হলেও আগের অনুভূতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন না নন্দ। তিনি বলেন, এগুলো সংস্কার করলেও তো স্থাপনাগুলোর আসল রূপ এখনকার মানুষ আর দেখতে পারবেন না। মিয়ানমারের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ক্ষতি কেবল আমাদের জন্য নয়, পুরো মানবজাতির জন্যই দুঃখের বিষয়।
সৃষ্টির পর থেকে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রটি। চার বছরের যুদ্ধে দেশের অন্তত ৩৫ লাখ মানুষ ঘর হারিয়েছেন এবং জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই দারিদ্র্যে পর্যবসিত হয়েছেন।
তবে থেইন মিইন্ট কো মনে করেন, সব ধ্বংসযজ্ঞকে ছাড়িয়ে গেছে গত মাসের ভূমিকম্প। লাওকা থাড়াফু প্যাগোডায় সার্ভে করতে এসে তিনি বলেন, ৬৫ বছরের জীবনে এমন ট্র্যাজেডি আমি আগে দেখিনি।
এই প্যাগোডাতে দেখে গেছে একটি বিস্ময়কর ঘটনা। প্রায় আট মিটার উঁচু মার্বেল পাথরের একটি বুদ্ধ ভাস্কর্য কোনও অলৌকিক উপায়ে যেন রক্ষা পেয়েছে। ভাস্কর্যটির বেদিতে কিছু আঘাতের চিহ্ন থাকলেও বুদ্ধের শান্ত, সম্মোহিত অভিব্যক্তি অক্ষুণ্ন রয়েছে।
প্যাগোডার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে আসা এক ব্যক্তি বলেন, এখানে কেউ আঘাত পায়নি। বুদ্ধও অক্ষত আছেন। এই প্যাগোডাটি বোধহয় আশীর্বাদপ্রাপ্ত!
তথ্যসূত্র: এএফপি