আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান থেকে শুরু করে সময়ের তুমুল আলোচিত ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য পর্যন্ত, অনেকটা নড়েচড়ে বসেছেন। প্রকাশ করেছেন তুমুল ক্ষোভ। সঙ্গে দেশের প্রায় সর্বস্তরের শিল্পী-কুশলী-দর্শক-সমালোচকের সমস্বর তো রয়েছেই। এমন তুমুল প্রতিক্রিয়া এর আগে ৫ আগস্টের পরে অন্য কোনও ব্যক্তি নিয়ে ঘটেছে বলে অনুমান করা যায় না। যেমনটা ঘটেছে অভিনেতা তথা বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরেশ যাকেরের পক্ষে।
সূত্রপাত, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর মিরপুরে গুলিতে বিএনপি কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণ হত্যার অভিযোগে ইরেশ যাকেরসহ ৪০৮ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ২০ এপ্রিল নিহতের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলার আবেদন করেন। খবরটি প্রকাশের পর থেকেই যেন ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মিডিয়া সংশ্লিষ্টরা।
প্রায় প্রত্যেকেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন এই বলে, অভিনেতা ইরেশ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েও তাকে বরণ করতে হচ্ছে খুনের অভিযোগ! অভিনেতার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়ায় চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা। নির্মাতা দীপংকর দীপন তার ফেসবুক দেয়ালে লেখেন, ‘ইরেশের নামে মামলা খুবই হতাশাজনক। এই মামলা যে মিথ্যা তা বোঝার জন্য গোয়েন্দা হতে হয় না। ইরেশ যাকেরকে নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা বলি, আমি দুবার উত্তরবঙ্গের শীতের জন্য বিভিন্ন সাহায্য সংগ্রহ করে সাঁওতাল পল্লীতে গরম কাপড় পৌঁছে দিয়েছিলাম সেতাবগঞ্জের ঝিলিক থিয়েটারের মাধ্যমে। খুব বড় করে কিছু করতে পারিনি, কিন্তু দুবারই আমাকে নিজের নাম প্রকাশ না করে সবচেয়ে বড় আর্থিক অনুদান দিয়েছিল ইরেশ যাকের। এই ইরেশ মানুষ মারার সাথে যুক্ত থাকবে- সেটা ভীষণ ফালতু স্টেটমেন্ট।’
বলেন, ‘অবশ্য ইরেশের মধ্যে কোনও গুণাবলী না থাকলেও মিথ্যা মামলায় কাউকে ফাঁসানো উচিত নয়। এটাও সত্যি কেউ কোর্টে মামলা করলে প্রচলিত আইনে তাকে থামানো যায় না। এক্ষেত্রে সত্যি আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন- সংস্কার প্রয়োজন। তবে যার নামে মামলা হলো তাকে গ্রেফতার বা অন্যান্য ঝামেলা থেকে দূরে রাখতে পারে আইন। সেটা অবশ্য এই সরকার ইরেশের ক্ষেত্রে করবেও। কিন্তু এই মামলায় ঢালাও ভাবে নাম দেয়ার এই প্রবণতা খুব বিপদজনক। ইরেশ আর রিংকুর বিষয় আসায়- বিষয়টা সবাই জানলো। এই রকমের মামলা হর হামেশাই হচ্ছে, প্রতিদিন হচ্ছে।’
‘ঢাকা অ্যাটাক’-খ্যাত এই নির্মাতা শেষে বলেন, ‘এই মিথ্যা মামলা দেয়ার প্রবণতা থেকে সমাজকে বাঁচানোর মূল হাতিয়ারটা গণমাধ্যম ও সমাজের কাছে। যা করতে হবে তা হচ্ছে, যে মামলা করলো তাকে সামনে নিয়ে আসা। প্রশ্ন করা যাদের অভিযুক্ত করলেন কোন লজিকে বা কোন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে করলেন- যেটা এখন আইন করছে না। তার কাছে কোনও প্রমাণ চাওয়া নয়। শুধু এই নামটা কি মনে করে দিলেন- এই প্রশ্নটা করা। উত্তরটা সবার সামনে তুলে ধরা। সেটাকে হেডলাইন করা। সেটা নিয়ে সোশাল মিডিয়ার আলোচনা হলে- মিথ্যা মামলার এই প্রবণতা কমে আসবে। আপাতত কোনও মামলায় ঢালাও নাম দেয়া ঠেকাতে আসলেই এই ছাড়া আর কোনও উপায় নাই। যতদিন অব্দি মামলা করা বিষয়ে আইনের সংস্কার হচ্ছে।’ মামলায় কীভাবে এসব আসামির নাম উল্লেখ করা হলো, তা জানতে চাইলে এই মামলার বাদী মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভাইয়ের মৃত্যুর পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। কিছু তথ্য পুলিশ ও আইনজীবীরাও দিয়েছেন। আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম না, তাই কে কীভাবে যুক্ত হলো, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।’
এদিকে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নেত্রী অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লেখেন, ‘আজ ইরেশকে হেনস্তার শিকার হতে দেখে হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। আমরা আগেও দেখেছি, যারা সাহস করে সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তাদের কী পরিণতি হয়েছে। তবুও যখন আমরা ভেবেছিলাম একটি ভালো, নিরাপদ দেশ গড়ছি, তখন এই দৃশ্য এখনও গভীরভাবে কষ্টদায়ক ও হতাশাজনক।’
বরাবরের বিপ্লবী নির্মাতা আশফাক নিপুন লেখেনে, ‘‘অগাস্ট মাসের ১ তারিখ ফার্মগেটে আমার সঙ্গে, আমাদের অনেকের সঙ্গে পুরোটা সময় ইরেশ যাকের এবং তাঁর স্ত্রী দাঁড়িয়েছিলেন ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের’ প্রতিবাদে। ওনার এবং আমাদের অনেক সহকর্মী একই সময় বিটিভি ভবনে শোক প্রকাশ করতে গেলেও উনি সেখানে যান নাই। ওনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হচ্ছে, হোক কিন্তু উনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা নিতান্তই হাস্যকর। এরকম গায়েবী মামলায় আসামি করতে গিয়ে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সত্যিকার আসামিদের পরিত্রাণের পথ যে সুগম করে দেয়ার পায়তারা হচ্ছে। সেই বিষয়ে সাবধান হন সরকার।’
অভিনেত্রী রাফিয়াত রশীদ মিথিলা লেখেন, ‘প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ, তারপর জুলাই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে হত্যা মামলা। মজার মিল, তাই না? আর সেটাও সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে, যিনি জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন।’
নির্মাতা শিহাব শাহীন লেখেন, ‘ইরেশ যাকের জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আর তার বিরুদ্ধে কিনা জুলাই হত্যা মামলা!’ নির্মাতা-প্রযোজক রেদওয়ান রনি লেখেন, ‘যিনি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তার বিরুদ্ধেই জুলাই হত্যা মামলা! লজ্জাজনক তো বটেই তবে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ এতে জুলাই হত্যা মামলাগুলোকে খেলনা ও মূল অপরাধীদের আড়াল করার ষড়যন্ত্রটা চোখের আড়ালে থেকে যায়। জুলাই আন্দোলন যখন থেকে শুরু হয় তখন থেকেই সক্রিয় ছিলেন ইরেশ যাকের। কিন্তু মনগড়া ঢালাও হত্যা মামলা খুবই হতাশাজনক! এই সরকারের কাছে একটাই চাওয়া আবারও যেন ভিন্ন ফর্মে ফ্যাসিবাদের চাষ শুরু না হয়, দ্রুত পদক্ষেপ কাম্য।’
এর আগে গত ২৫ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) কর ফাঁকির অভিযোগে এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেডের (এশিয়াটিক এমসিএল) সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করে। এটি এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির প্রধান প্রতিষ্ঠান। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরেশ যাকের এবং চেয়ারপারসন তার মা অভিনেত্রী সারা যাকের।