পরিচিত গল্পের এক বিয়োগান্তক ছবি ‘জংলি’। বাবা মায়ের দায়িত্ব অবহেলার কারণে যে সন্তান বখে যায়, তার কাছে পিতৃত্ব খুঁজে ফেরার এক করুণ গল্পের ছবি ‘জংলি’। ‘শান’-এর পর এম রাহিম ও নায়ক সিয়াম আহমেদের দ্বিতীয় ছবি ‘জংলি’। প্রচলিত বাংলা ছবির ধারায় দর্শক ফেরানোর চেষ্টা সম্বলিত এক ছবিও ‘জংলি’। শিশু মৃত্যু কাম্য না হলেও (সম্ভবত ‘ডুমুরের ফুল’ বা ‘অশিক্ষিত’ ছবি দিয়ে এই ধারার শুরু) এই ধারার সর্বশেষ ছবি ‘জংলি’। নামের কারণে কি না জানি না, অন্য একজনকে বিয়ে করার কারণে বিয়ের দিন প্রেমিকা ও তার স্বামীর ছবিতে রাগে ক্ষোভে দুঃখে নায়কের হিসি করে দেয়ার এক ছবিও ‘জংলি’। রক্তের সম্পর্ক না হলেও বাবা ও মেয়ের বন্ধন নিয়ে এক ভিন্ন মাত্রার চেষ্টার ছবি ‘জংলি’ কিংবা জন্ম না দিয়েও আদর্শ বাবা হতে পারার ছবি ‘জংলি’।
জনি ক্রিকেটার হতে চেয়েছিল। ১৪ বছর বয়সে মা মারা গেলে বদলে যায় তার জীবন। বাবার সাথে তার সম্পর্ক ভালো যায় না। সে নূপুরকে ভালোবাসে। একদিন নূপুরের মোবাইল বন্ধ পায় জনি। খবর পেয়ে নূপুরের বিয়ে-বাড়িতে হাজির হয় সে। নূপুর ও তার বরের ছবিতে হিসি করে দেয়। মারপিট শেষে পুলিশ থানায় নিয়ে যায় তাকে। জনির বাবাকে রিং দেয়া হয়। বাবা পুলিশকে জানিয়ে দেয় আর রিং না দিতে। ছাড়া পেয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় জনি। অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেখানে সে থাকে সেই একঘেয়ে ও হিংস্র জীবনে একদিন তার সাথে দেখা হয় এক ছোট্ট মেয়ে পাখির। জীবনটা বদলে যায় জনির। শুরু হয় ছবির আসল গল্প। ছবিতে জনির চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ, তিথি এবং নূপুরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শবনম বুবলী এবং প্রার্থনা ফারদীন দিঘী। আইনজীবীর চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম ও এরফান মৃধা শিবলু, বিচারকের চরিত্রে আফসানা মিমি, ভাইরাল সাংবাদিকের চরিত্রে রাশেদ মামুন অপু, পাখির চরিত্রে নৈঋতা, গ্যারেজ মালিকের চরিত্রে সোহেল খান, তিথির বাবার চরিত্রে সুব্রত এবং দাদীর চরিত্রে দিলারা জামান অভিনয় করেছেন।
ছবিতে সিয়াম আহমেদের লুক এবং অভিনয়ের ধরন ভিন্ন ছিল। সম্ভবত সিয়ামের জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয় এই ছবিতে। সিয়ামের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন শিশুশিল্পী নৈর্ঋত। ভাইরাল সাংবাদিক সুজনের চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন রাশেদ মামুন অপুও। ‘দেয়ালের দেশ’ ছবির মতো এই ছবির অফ ট্র্যাক চরিত্রেও বুবলী ভালো করেছেন।
‘জংলি’ ছবির চারটি গানের সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। ‘জনম জনম’ শিরোনামের গানের কথাও তার লেখা এবং গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন তাহসান খান ও আতিয়া আনিসা। ‘বন্ধুগো শোনো, তুমি ছাড়া আমি আমি ছাড়া তুমি মানে হয় না কোনও’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন কৃষ্ণেন্দু। ‘বাবা তুমি ছাড়া’ শিরোনামের বাবাকে নিয়ে এবং ‘যদি আলো আসে’ শিরোনামের গানটাও শ্রুতিমধুর। এই প্রথম কোনও ছবির সবগুলো গানের সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। ‘জংলি’র গল্প লিখেছেন আজাদ খান, চিত্রনাট্য যৌথভাবে লিখেছেন মেহেদী হাসান মুন ও সেঁজুতি সাহা। ছবির চিত্রগ্রহণে ছিলেন রিপন চৌধুরী। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এমআইবি স্টুডিও, টাইগার মিডিয়ার পক্ষে প্রযোজক ছিলেন জাহিদ হাসান অভি এবং পরিবেশক অভি কথাচিত্র। ২০২৪ সালে ঢাকা ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় শুটিং শুরু হয়েছিল এই ছবির এবং মুক্তি পায় ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ।
এবার ভালো লাগা ও অসঙ্গতির বয়ান। ছবির শুরুতে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া শিশুটির গায়ে ইঁদুর উঠলেও না কামড়ানোর ঘটনাটা মেকি মনে হয়েছে। এম রাহিম পরিচালক হিসেবে চেষ্টা করেছেন। বাঙালি এমনিতেই আবেগ প্রবণ। মধ্যবিত্তের সম্পর্কের গল্প এখনও দর্শকদের আবেগপ্রবণ করে। জনির বাবা মায়ের গল্প ছবিতে উন্মোচিত করা হয়নি। আইনজীবী শহীদুজ্জামান সেলিমের সাথে সিয়াম ওরফে জনির শত্রুতা কেন তারও কোনও ব্যাখ্যা নেই। আদালতে ব্যাড প্যারেন্টিং সম্পর্কে লেকচার বা বয়ান আছে অন্য কোনও দৃশ্যে এর বিস্তার নেই। হৃদয়ে ছিদ্র থাকা বড় কোনও রোগ না এখন, তবু পাখির মৃত্যুর গল্প সাজানো হয়েছে। শেষ দৃশ্যের সময় পাখিকে যারা ব্যাড টাচ করেছে, জনির বিরুদ্ধে যে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে তাকেও জনির সাথে কান্নারত অবস্থায় দেখানো হয়েছে, যার কোনও যুক্তি নেই।
দিঘীর চরিত্রটা একেবারেই দাগ কাটেনি। দিঘী কী কারণে জনিকে বিয়ে করছে না, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যাও নেই। একজন গ্যারেজকর্মীকে একজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে ভালোবাসতে যাওয়াটাই দৃষ্টিকটু, কারণ ডাক্তার তখনও জনি সম্পর্কে জানতো না। ছবির ট্রেলার দেখে মনে হয়েছিল এটা অ্যাকশন ছবি, বাস্তবে দুটো মারপিটের ঘটনা আছে তামিল ঘরানার, যার একটা দেখে আলোচিত হিন্দি ছবি ‘বজরঙ্গি ভাইজান’র কথা মনে হয়েছে।
তবে ছবির ভালো দিক এর শ্রুতিমধুর গান এবং সিয়াম, নৈর্ঋত, রাশেদ মামুন অপু ও বুবলীর অভিনয়; যা দর্শকদের কান্নাকাতর করেছে। মেয়ে শিশুদের গুডটাচ ব্যাডটাচ ও প্রতিরোধ শেখানো এবং হাস্যরসের ঘটনাগুলো মজার। এম রাহিমকে তবু ধন্যবাদ জানানো যেতে পারে।
জয় হোক বাংলা ছবির।
জংলি: ৫/১০
অভিনয়ে: সিয়াম, বুবলী, নৈর্ঋত ও দীঘি
পরিচালক: এম রাহিম
চিত্রগ্রাহক: রিপন চৌধুরী
প্রযোজনা: এমআইবি স্টুডিও ও টাইগার মিডিয়া
পরিবেশক: অভি কথাচিত্র
মুক্তি: ৩১ মার্চ ২০২৫
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
‘চক্কর ৩০২’ ৭/১০: গল্পের চক্করে ভরা এক ছবি
‘দাগি’ ৭/১০: প্রায়শ্চিত্তের গ্লানি মাখা এক ছবি
‘বরবাদ’ ৫/১০: শিশুদের নিয়ে না দেখার মতো ছবি
৮৪০: রহস্যময়তার আড়ালে মজাদার এক রাজনৈতিক স্যাটায়ার
দরদ: দরদহীন নির্মাণের এক প্রশ্নবিদ্ধ ছবি!
৩৬-২৪-৩৬: সিনেমার পর্দায় ‘ওটিটি কনটেন্ট’
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক ছবি
ফাতিমা: সাধারণ এক নারীর ‘অসাধারণ’ সংগ্রামের ছবি
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
খুফিয়া: বাংলাদেশ নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভাবনার’ ভারতীয় ছবি!
অন্তর্জাল: সাইবার থ্রিলার নিয়ে স্মার্ট ছবি
এমআর-৯: ‘মাসুদ রানা’ আছে ‘মাসুদ রানা’ নেই!
১৯৭১ সেই সব দিন: ৫৩ বছর আগের বাস্তবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
আম কাঁঠালের ছুটি: দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি
প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!
প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়
লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!
জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!