নির্মাতা ও অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবনের প্রথম ছবি ‘চক্কর ৩০২’। পুরো ছবিজুড়ে গল্পই যখন প্রধান চরিত্র তখন শেষ না হওয়া পর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার এক ছবি ‘চক্কর ৩০২’। পুরোদস্তুর বাংলাদেশি পুলিশি গল্পের উত্তেজনা, আনন্দ, বেদনা আর খুনের পরিণতি ঘেরা এক ছবি ‘চক্কর ৩০২’। একই সাথে মারদাঙ্গা ও ফর্মুলা ছবির বিপরীতে পুলিশকে অযথা গ্ল্যামারাইজ না করার এক ছবিও ‘চক্কর ৩০২’। অনুদানের ছবি হওয়া সত্ত্বেও অনুদানের ছবি মনে না হওয়া এক ছবি ‘চক্কর ৩০২’।
সম্ভবত ছবির প্রদর্শনীর সময় নিয়ে ফিল্মি পলিটিক্সের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না দিতে পারার ষড়যন্ত্রবিদ্ধ এক ছবি ‘চক্কর ৩০২’। মোশাররফ করিম ও সুমন আনোয়ারের অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা ছবি ‘চক্কর ৩০২’।
সদ্য কৈশোর পেরোনো তিন বন্ধু সাদমান, লিমা ও রাইয়ান চৌধুরীর হ্যাং আউটের ঘটনা দিয়ে শুরু হয় ছবি। নেশা করার পর ফিলিংসের চূড়ায় উঠে যাওয়া দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয় নেশাকারক দ্রব্য ফুরিয়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে। সাদমান যে বাসায় থাকে সেটা রাইয়ান চৌধুরীর নেয়া, যার ভাড়া টাকাওয়ালা বাবার সন্তান রাইয়ানই দেয়। রাইয়ানের সাথে ঝগড়ার পর পরই বাসায় ফিরে খুন হয় সাদমান। সবার সন্দেহ হয় লিমা আর রাইয়ানকে। রাইয়ানের বাবা বিখ্যাত সেলিব্রেটি হাসান চৌধুরী, মা ব্যারিস্টার জেবিন চৌধুরী। সারা দেশে এই খুনের ঘটনা দারুণ আলোচিত হয়। বাবাহীন একাকী এক মা’র সন্তান সাদমানের হত্যার বিচারের দাবি প্রবল হয়।
ঘটনার তদন্তে পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয় ডিবি ইন্সপেক্টর মইনুলকে। মইনুল নিজেও খুনের তদন্তে নেমে চক্কর খায়, চক্কর খায় দর্শকও। প্রতি চক্করে যেমন বেরিয়ে আসে রাইয়ানের বাবা-মা হাসান চৌধুরী ও জেবিনের জীবনের টানাপোড়েন, সাদমানের মা নীলা ও তার কথিত প্রেমিক মিজানের সম্পর্ক, তেমনি বেরিয়ে আসতে থাকে নেশার জগতের গণ্ডার বাবু কিংবা গডফাদার টাইপ ডেইরি আসলামের কাহিনি। পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই বুঝতে পারেন না সাদমানকে আসলে কে বা কারা খুন করেছে। বুঝতে পারেন না দর্শকরাও। ছবির শেষে এসেও থেকে যায় আগামীর জন্য টুইস্ট!
ছবিতে ইন্সপেক্টর মইনুল ও গণ্ডার বাবুর চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম ও সুমন আনোয়ার। পুলিশি শরীর না নিয়েও যে পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করা যায় মোশাররফ করিম সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। সুমন আনোয়ারকেও মাদক কারবারি মনে হয়েছে পুরোদস্তুর। এছাড়া হাসান চৌধুরীর ভূমিকায় রওনক হাসান, জেবিনের চরিত্রে তারিন জাহান, মিজানের চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, নীলার চরিত্রে মৌসুমী নাগ, রওনকের বান্ধবীর চরিত্রে মুন খুব ভালো অভিনয় করেছেন।
মোশাররফ করিমের স্ত্রীর চরিত্রে রিকিতা নন্দী শিমু, লিমার চরিত্রে বুশরা, সাদমানের চরিত্রে শান, পুলিশ অফিসার সজীবের চরিত্রে শাশ্বত এবং রাইয়ানের চরিত্রে মানানসই অভিনয় করেছেন আরিয়ান।
এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন ও নাহিদ হাসনাত। চিত্রগ্রহণে ছিলেন কামরুল হাসান খসরু। ২০২১-২২ এ অনুদান প্রাপ্ত এই ছবির শুটিং শুরু হয় ২০২৩ সালে এবং ঢাকার দিয়াবাড়ি, মানিকগঞ্জ, জৈনাবাজার এবং সদরঘাট ছাড়াও আরও কয়েকটি স্পটে। ছবি মুক্তি পায় ২০২৫ এর ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিনে। ‘চক্কর’ ছবিতে গান ব্যবহৃত হয়েছে চারটি। রাজ্জাক দেওয়ানের কথায় পুরনো একটি গান এই ছবিতে ব্যবহারের পর আলোচনায় আসে। ‘কাউয়ায় কমলা খাইতে জানে না’ শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন কাজল দেওয়ান। মোশাররফ আলিফ ছিলেন এই গানের কোরিওগ্রাফার এবং আলিফা স্কোয়াডের নাচ ছিল সাথে। ইমন চৌধুরীর সুর, কণ্ঠ ও সংগীত পরিচালনায় ‘নীল আসমানে’ শিরোনামের গানটিও ব্যবহৃত হয়েছে ছবিতে। ‘থোকায় থোকায়’ শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ন্যানসি ও নীরব এবং অমিত চ্যাটার্জীর সংগীতায়োজনে ছবির শেষ গান ‘বোকা মানুষ’ শিরোনামের গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন সুদীপ্ত।
এই ছবির সবচেয়ে ভালো দিক গল্প বলার ঢং এবং পরিচালকের মুনশিয়ানা। টানটান উত্তেজনার সাথে পরিচালক শরাফ আহমেদ জীবন বারবার চক্কর খাইয়েছেন দর্শকদের। এমন কী খুনের রহস্য উদঘাটনের পরও হাসান চৌধুরীর স্ত্রী জেবিন ও তাদের ছেলে রাইয়ানের জীবনের ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও আছে ছবিতে। আছে পুত্র হারানো মা ও বিচারাধীন পুত্রের মায়ের আক্ষেপ ও ঝগড়ার দৃশ্য। পুলিশ ইন্সপেক্টরের জীবনের নানা দিক আর অপারেশনে নেমে প্রাণ হারানো সজীবের মা ও ইন্সপেক্টর মইনুলের সাথে কান্নাকাতর দৃশ্য কিংবা সজীবকে ভুলতে না পারার ঘটনাও দাগ কাটে দর্শকদের মনে।
ছবিতে ব্যবহৃত কয়েকটা গালি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেও পারেন। তবে এমন ছবি বাংলা ছবির জগতে অবশ্যই আলোচনার খোরাক যোগাবে। ফিল্ম পলিটিক্স বাদ দিয়ে এমন ছবি বেশি দেখার পরিবেশ তৈরি করাটাও সিনেমা শিল্প বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম পাথেয় হতে পারে।
জয় হোক বালা ছবির।
চক্কর ৩০২: ৭/১০
পরিচালক: শরাফ আহমেদ জীবন
চিত্রনাট্য: সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন ও নাহিদ হাসনাত
চিত্রগ্রহণ: কামরুল হাসান খসরু
প্রযোজক: কারখানা প্রডাকশন
মুক্তি: ৩১ মার্চ ১০২৫
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
‘দাগি’ ৭/১০: প্রায়শ্চিত্তের গ্লানি মাখা এক ছবি
‘বরবাদ’ ৫/১০: শিশুদের নিয়ে না দেখার মতো ছবি
৮৪০: রহস্যময়তার আড়ালে মজাদার এক রাজনৈতিক স্যাটায়ার
দরদ: দরদহীন নির্মাণের এক প্রশ্নবিদ্ধ ছবি!
৩৬-২৪-৩৬: সিনেমার পর্দায় ‘ওটিটি কনটেন্ট’
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক ছবি
ফাতিমা: সাধারণ এক নারীর ‘অসাধারণ’ সংগ্রামের ছবি
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
খুফিয়া: বাংলাদেশ নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভাবনার’ ভারতীয় ছবি!
অন্তর্জাল: সাইবার থ্রিলার নিয়ে স্মার্ট ছবি
এমআর-৯: ‘মাসুদ রানা’ আছে ‘মাসুদ রানা’ নেই!
১৯৭১ সেই সব দিন: ৫৩ বছর আগের বাস্তবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
আম কাঁঠালের ছুটি: দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি
প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!
প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়
লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!
জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!