৩৪ বছর। অভিনয় জগতে সংকটময় বয়স বটে। বিশেষ করে যদি এ বয়সেও তারকাখ্যাতির শিকে না ছিঁড়ে। চীনা অভিনেত্রী উ ছিয়েনও ছিলেন এমন অনিশ্চয়তায়। টানা দশ বছর অভিনয় করেছেন পার্শ্বচরিত্রে। এরপর ২০২৪ সালে অতি-স্বল্পদৈর্ঘ্যের চীনা নাটকের (যাকে বলে শর্ট সি-ড্রামা) দুয়ারে দাঁড়াতেই ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরতে থাকে বুলেট ট্রেনের গতিতে।
গত বছর থেকেই ক্ষুদ্র-দৈর্ঘ্যের সি-ড্রামাগুলো জনপ্রিয় হতে শুরু করে বিশ্বব্যাপী। ‘ফ্ল্যাশ বিবাহের স্বামী একজন ধনী মানুষ’ এ নামের একটি নাটকে অভিনয় করে উ ছিয়েন আচমকাই নজর কাড়েন চীন ও বৈশ্বিক দর্শকদের। তার ভাষায়, ‘ছোট নাটিকা যেন আলোর ঝলকানি। সেটাই আমাকে লাইমলাইটে নিয়ে এসেছে।’ এরপর আর বসে থাকতে হয়নি। ডিজিটাল পর্দায় উ ছিয়েন খুঁজে পান তার স্থায়ী আসন।
নাটকটি ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট মুক্তি পায়। প্রতিটি পর্ব মোটে দুই মিনিট করে। মোট ৬৯টি পর্ব ছিলো এই নাটকের। ষষ্ঠ হাইনান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মাইক্রো-শর্ট ড্রামা গ্লোবাল সামিটে ‘সেরা হট ড্রামা’ পুরস্কার জিতে নেয় ওটা।
সরকারি চাকরি ছেড়ে
উ ছিয়েনের জন্ম ইনার-মঙ্গোলিয়ার পাওতৌ শহরে। পড়া শেষে শাংহাইয়ের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বছর তিনেক পর বুঝতে পারেন, এই জীবনের আয়নায় তার স্বপ্নগুলো প্রতিফলিত হচ্ছে না। ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে পথ ধরেন অভিনয়ের।
প্রথমদিকে ক্ষুদ্র চরিত্র দিয়ে শুরু। মা-খালার ভূমিকায় দেখা যেত বেশি। এমনকি একবার তার ‘ছেলে’ হয়েছিলেন যিনি, তার বয়স ছিল উ’র চেয়েও বেশি! সেই সময়টায় অবশ্য কোনও চরিত্রেই ‘না’ ছিল না তার। ভয় ছিল কাজ না পাওয়ার। শাংহাইতে জীবন চালাতে অভিনয়ের পাশাপাশি ব্যবসাও করতে হয়েছিল তাকে। ২০১৯ সালের পর ব্যবসা মন্দা গেলে পুরোপুরি নেমে পড়েন অভিনয়ের মায়াবী জগতে।
প্রথম সাফল্য
শুরুর দিকে একটা নাটক শেষ হলে পরের কাজের নিশ্চয়তা থাকত না। মাসের পর মাসও অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু ‘ফ্ল্যাশ বিবাহের স্বামী একজন ধনী মানুষ’ মুক্তির পর ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘুরতে থাকে। লাইভ স্ট্রিমিংয়ে ভক্তসংখ্যা একশ থেকে এক লাফে দশ হাজার ছাড়ায়। সামাজিক মাধ্যমে ফলোয়ার বাড়তে থাকে লাখে লাখে। ২০২৩ সালের আগস্টে নাটকটি মুক্তির পর নিয়মিত কাজের প্রস্তাব আসতে থাকে।
প্রসঙ্গ মাইক্রো ড্রামা
উ ছিয়েন বলেন, ‘ছোট নাটককে অনেকেই হালকাভাবে নেন। বাস্তবে দেখা গেল, এ কাজে আরও বেশি দক্ষতা থাকা চাই। এখানে বড় পর্দার মতো শরীরী অভিব্যক্তির জায়গা কম; মুখের সূক্ষ্ম পরিবর্তন, চোখের ভাষা দিয়েই অনেক আবেগ একসঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে হয়।’
তার মতে, এই মাধ্যমে সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ছেলের হাতের মোয়া নয়। বিশেষত, খল চরিত্রগুলোর অভিনয়ে কিছুটা অতিরঞ্জিত বিষয় নিয়ে আসতেই হতো। এমনও হয় যে, অভিনয়ের স্বার্থে সত্যিই জোরসে কাউকে চড় কষাতে হতো। আর এ কাজে হাত কাঁপলে চলবে না। এটাই নাকি ছোট নাটকের নিজস্ব রীতি।
শুটিংয়ের সময় উ ছিয়েন ভাবতে পারেননি, এটাই তার ক্যারিয়ারের সূচনা বিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলেন, ‘আহ, আমি কি দাদীর চরিত্রের মতো যথেষ্ট বয়সী?’ তবে বয়স নিয়ে চিন্তা ছিল না তার। নজর দেন চরিত্রের খুঁটিনাটি বিষয়ে। শিখে নেন, বয়স হলে তরুণদের চেয়ে নড়াচড়া হবে ধীর, পিঠ খানিকটা বাঁকা হতে পারে। আবার চরিত্রের বয়সটা হলো পঞ্চাশ, সত্তর বা আশি নয় যে তার হাঁটতে খুব কষ্ট হবে। আর এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর দিতে গিয়েই বুঝলেন, চরিত্র বা চরিত্রের বয়স যতই হোক, অভিনয় দক্ষতাই আসল। উ ছিয়েনের টিপস
মাইক্রো ড্রামার বিষয়ে উ ছিয়েন মনে করেন, ‘দীর্ঘ নাটকের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য নেই। তবে এ ধরনের নাটকে দর্শকদের দৃষ্টি থাকে তীক্ষ্ম। বিপরীতে বসা ব্যক্তিকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসা বা তার জন্য দুঃখবোধ কাজ করছে কিনা সেটা দর্শকদের বোঝাতে হবে চোখ ও অভিব্যক্তি দিয়ে।’
আর ছোট নাটকের অভিব্যক্তিগুলোকে হতে হয় তুলনামূলক অতিরঞ্জিত এবং সরাসরি। উ ছিয়েন প্রথম দিকে এসবের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। হঠাৎ অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়া বা মুখের ভাব বদলে যাওয়ার বিষয়টি ধরতে তার বেগ পেতে হয়েছিল।
উ ছিয়েন বলেন, ‘ছোট নাটকে মাঝেমাঝে খারাপ চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা আমার মুখে জোরে থাপ্পড় মেরেছিল। এর কোনও বিকল্পও নেই। ছোট নাটকগুলোর বৈশিষ্ট্যই এমন।’
রূপালী স্বপ্ন
চীনসহ এশিয়ার অনেক দেশেই মধ্যবয়সী ও বয়স্কদের নিয়ে নাটকের চাহিদা বেড়েছে। উ ছিয়েন চলতি বছরেই তিন-চারটি নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে তার চূড়ান্ত স্বপ্ন সিনেমায় কাজ করা। তিনি বলেন, ‘সিনেমা অনেক সূক্ষ্ম মাধ্যম। এখানে চোখের ভাষা, ক্ষুদ্রতম অভিব্যক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। আমি সেই গভীরতার ছোঁয়া পেতে চাই।’
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, চায়না মিডিয়া গ্রুপ, বেইজিং