দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার ছোট্ট একটা গ্রামের অভূতপূর্ব এক গল্প যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো এবারের সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। ২৯ জানুয়ারি রাতে পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিমশীতল ইউটাহ রাজ্যের পার্কসিটির হলিডে ভিলেজ সিনেমা হলে বসে ছবিটি দেখার সময়, যেন মনের অজান্তে ঢুকে পড়লো দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট মানচিত্রের বাংলাদেশও!
‘ডিজে আহমেত’ ছবিটির প্রেক্ষাপট যেন এমনই, পৃথিবীর যে কোনও অঞ্চলকে সংযুক্ত করে নিতে পারবে অজান্তে; যেখানে এগিয়ে যাওয়ার বাধা হিসেবে নানাভাবে পথ আগলানোর চেষ্টা করবে ধর্ম ও সামাজিক ট্যাবু। শুধু ধর্ম নয়, এই সিনেমায় তরুণ নির্মাতা জর্জি এম. উনকোভস্কি দেখাতে পেরেছেন ট্র্যাডিশনাল মিউজিক ও ড্যান্সের বিপরীতে ডিজে মিউজিকের বৈশ্বিক বিপ্লব, মসজিদের ইমামের সোশ্যাল হ্যান্ডেল-প্রীতি, পিতৃতান্ত্রিক কঠোর সমাজ, ধনী-গরিবে অসম প্রেম এবং মা হারা এক শিশুকে আগলে রাখা বড় ভাইয়ের মাতৃত্বের গল্প। যে গল্প বা চরিত্র বা ঘটনাগুলো বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ঘটে চলেছে কম বেশি, তখন থেকে এখনও।
ম্যাসেডোনিয়া বা বাংলাদেশ নয়, এই গল্পটা গ্লোবাল। অসংখ্য সিনেমা ও সাহিত্যে ঘুরে ফিরে এমন ঘটনা এসেছে ঘুরে-ফিরে। তবুও ‘ডিজে আহমেত’-এর স্টোরি টেলিং, সিনেমাটোগ্রাফি, ন্যাচারাল অভিনয়, সংলাপ, সংগীত, আবহ সংগীত, লোকেশন, ইমোশন, অ্যাংরিনেস এবং অসাধারণ সব সিম্বলিক দৃশ্য; সিনেমাটিকে আলাদা করে রাখবে ইতিহাসের পাতায়। যেখানে প্রেম, সংগীত, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, সংসার, আবেগ, অভিমান, অসহায়ত্ব আর বিপ্লব হেঁটেছে ভেড়ার পালের মতো করে। এবারের সানড্যান্স উৎসবের অন্যতম আলোচিত সিনেমা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ডিজে আহমেত’। যার চূড়ান্ত রায় আসতে পারে একাধিক বিভাগে পুরস্কার জয়ের মাধ্যমে। ছবিটি উৎসবের ওয়ার্ল্ড সিনেমা ড্রামাটিক কম্পিটিশন-এ লড়াই করছে।
নির্মাণের পাশাপাশি এর গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন জর্জি এম. উনকোভস্কি। এটি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। যা নির্মাণ করতে তার সময় খরচ হয়েছে ৫ বছর। কারণ, অর্থ সংকট। প্রিমিয়ার শেষে সেটাই জানালেন তরুণ এই নির্মাতা।
প্রিমিয়ার শেষে নির্মাতা সবার সামনে হাজির হন, ছবির প্রধান অভিনেতা ১৫ বছর বয়সী তরুণ আরিফ জেকাপসহ প্রযোজক ও সিনেমাটোগ্রাফারদের নিয়ে। জানান, সিনেমাটি নির্মাণের গল্প।
উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার দূরবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত ইউরুক গ্রামে বসবাসরত ১৫ বছর বয়সী আহমেতের দুটি স্বপ্ন—সংগীতের ছন্দ গ্রামের সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এবং টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকা পাশের বাড়ির সুন্দরী মেয়েটির মন জয় করা। কিন্তু দুটি জিনিসের একটিও তার হাতে নেই। কারণ, মেয়েটির বাবা ইতোমধ্যেই অন্যের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। অন্যদিকে বাবার ভয়ে ঘরে সংগীত শোনার স্পিকারও তুলতে পারছে না। বিপরীতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেব তরুণ আহমেতের পেছনে ঘুরতে থাকে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার জন্য! গল্পটার সারমর্ম সাদামাটা মনে হলেও, এর প্রতিটি দৃশ্য, সংলাপ ও সংগীতের যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তরুণ নির্মাতা, সেটি মুগ্ধ করেছে সানড্যান্স দর্শক-সমালোচকদের।
পরিচালক জর্জি এম. উনকোভস্কি পাঁচ বছর ধরে অর্থায়ন ও প্রযোজনার চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে অবশেষে উৎসবে অংশ নিয়ে দর্শকদের রিভিউ পেয়ে ভালোই উপভোগ করছেন সময়টা। ম্যাসিডোনিয়ার এই লেখক-পরিচালক জানান, তিনি প্রথম ‘ডিজে আহমেত’-এর আইডিয়া খুঁজে পান ২০২০ সালে, যখন তার শর্ট ফিল্ম ‘স্টিকার’ সানড্যান্সে প্রদর্শিত হয়। ‘সিনেমাটি নির্মাণের জন্য আমরা প্রথম তহবিল পেয়েছিলাম ২০২০ সালের শেষে, কিন্তু সম্পূর্ণ অর্থের ব্যবস্থা করতে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়—মাত্র তিন মাস আগে সবকিছু চূড়ান্ত হয়’, বলেন উনকোভস্কি।
ছবিটির শুটিং হয়েছে ইউরুক সম্প্রদায়ের ছোট্ট একটা গ্রামে। সেটি উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। ইউরুকরা মূলত আধা-যাযাবর রাখাল সম্প্রদায়, যারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও বিস্তৃত। তাদের প্রধান বিশেষত্ব হলো উলের কাজ এবং রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও ভেড়া পালন। সিনেমাতেও ঠিক সেই সম্প্রদায়ে জীবনাচরণ তুলে ধরার সর্বোচ্চ নান্দনিক চেষ্টা ছিলো।
উনকোভস্কি জানান, গ্রামটি তার বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে হলেও তিনি আগে কখনও যাননি। তিনি বলেন, ‘এই সিনেমার লোকেশন ঠিক করার জন্য আমরা দেড় বছর ধরে ৫০টির বেশি ইউরুক গ্রাম পরিদর্শন করি। অবশেষে এমন একটি গ্রাম খুঁজে পাই যেখানে এখনও সম্প্রদায়ের পুরনো ঐতিহ্য মেনে চলা হয়। সিনেমায় যা দেখেছেন, বাস্তবেও সেই গ্রামের চিত্র এমনই।’
গ্রামটি সিনেমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা শুটিংয়ের আগে তিন মাস স্থানীয়দের সঙ্গে কাটিয়েছি, তাদের সংস্কৃতি বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রধান অভিনেতা আরিফ জাকুপও সেই গ্রামেরই ছেলে।’
এই চলচ্চিত্রের অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো অভিনয়শিল্পীদের ন্যাচারাল অভিনয়। বিশেষ করে আরিফ জাকুপ (আহমেত), ডোরা (প্রেমিকা) এবং আগুশ আগুশেভ (আহমেতের ছোট ভাই)—যে চরিত্রটি সে অর্থে কোনও কথা বলে না, অথচ তার এক্সপ্রেশন যে কোনও দর্শকদের হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করতে বাধ্য।
উনকোভস্কি বলেন, ‘আমরা ম্যাসিডোনিয়ার এই জাতিগোষ্ঠীর ৩ হাজার শিশুর অডিশন নিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত ৬০ জনে নামিয়ে আনি। তারপর আগুশকে নির্বাচন করি।’
আগুশকে খুঁজে পাওয়া ছিল নির্মাতার জন্য হীরার সন্ধান! ‘সে সত্যিই অসাধারণ। আরিফও দুর্দান্ত, সে সিনেমার আহমেতের মতোই বাস্তবে এক তামাক চাষি পরিবারের ছেলে।’
নিজের স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘স্টিকার’-এর পাঁচ বছর পর আবার সানড্যান্সে ফিরতে পেরে কিছুটা উত্তেজিত ও নার্ভাস অনুভব করছেন উনকোভস্কি। ‘আমি সানড্যান্সের দর্শকদের ভালোবাসি। তারা সাধারণত খুবই সহানুভূতিশীল। সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলো, এখানে বসে আমার কাস্ট ও ক্রুদের সঙ্গে সিনেমাটি দেখা।’ যোগ করলেন তরুণ নির্মাতা।
২৯ জানুয়ারির প্রিমিয়ার শেষে বেশিরভাগ দর্শক-সমালোচকই বলছিলেন, ছবিটি এবার জয় করবে সানড্যান্স। আর নির্মাতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার লক্ষ্য ছিলো সানড্যান্স থেকে শুরু করার। সেটা হলো। এবার তিনি ছবিটি নিয়ে বাকি দুনিয়া ঘুরতে চান। জানাতে চান, তার দেশের গল্পটা। যে গল্পের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছেন নির্মাতা নিজেও।
৪১তম সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এর এবারের পর্দা উঠেছে ২৩ জানুয়ারি। নামবে ২ ফেব্রুয়ারি। উৎসব চলছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ রাজ্যের পার্ক সিটি ও সল্ট লেক সিটি নামের দুটি শহরে বিস্তৃত পরিসরে।
স্বাধীন ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের জন্য বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব সানড্যান্স। ৪০ বছর ধরে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দারুণ সব কাজ তুলে ধরার জন্য খ্যাতি আছে এই আয়োজনের। আমেরিকান অভিনেতা-নির্মাতা রবার্ট রেডফোর্ড প্রতিষ্ঠিত উৎসবটির এবারের আসরে কমেডি, ড্রামা, হরর, প্রামাণ্যচিত্র, অ্যানিমেশন, টিভি সিরিজসহ সব ধরনের উপকরণ আছে! এরমধ্যে প্রায় অর্ধেকই নবাগত পরিচালকদের বানানো।
সানড্যান্স উৎসবের পরিচালক ইউজিন হার্নান্দেজ মনে করেন, এবারের আসর যথারীতি নবাগত নির্মাতাদের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। হেভিওয়েট নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি এই উৎসবে কিছু স্বল্প বাজেটের ছবি দর্শকদের চমকে দেয়। গত আসরে তাইওয়ানিজ-আমেরিকান পরিচালক শন ওয়াংয়ের বয়ঃসন্ধি বিষয়ক কমেডি ‘ডিডি’ ছিল তেমনই একটি ছবি।
ট্রেলারে ‘ডিজে আহমেত’: