নাট্যজন মামুনুর রশীদ আর শিল্পকলা একাডেমি, দুটো নাম যেন বাংলাদেশের জন্য পরিপূরক। কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেটি এখন দাঁড়ালো একে অপরের বিপরীতে। তা না হলে অনেক জলঘোলা শেষে খোদ সৈয়দ জামিল আহমেদের মতো নাট্যজনও কেমন করে মামুনুর রশীদকে মঞ্চ থেকে নির্বাসনে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন!
বিষয়টি প্রকাশের পর ক্ষোভে ফেটে পড়েছে নাট্যকর্মীরা, সঙ্গে দর্শক-সমালোচকরাও।
প্রায় দুই মাস হলো দেশের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শিল্পকলা একাডেমি ঘিরে চলছে চরম অস্থিরতা কিংবা অরাজকতা। একদিকে চলতি শো বন্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে নাট্যকর্মীদের প্রতিবাদ সভায় ডিম ছোড়া হচ্ছে, আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, অব্যাহতি নিচ্ছেন মামুনুর রশীদ। সব মিলিয়ে এতটা চরম পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েনি নাট্যকলা।
এর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হলো মামুনুর রশীদকে মঞ্চ থেকে দূরে থাকার প্রসঙ্গ। বলা যায় এটি একরকম বারুদের মতো জ্বলে উঠলো।
ঠিক কী ঘটেছিল কিংবা কেমন করে নির্বাসনে পাঠানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। সেটি জানতে চাইলে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘‘শিল্পকলার ডিজি সাহেব (সৈয়দ জামিল আহমেদ) ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন, আমি যাতে শিল্পকলায় অভিনয় না করি। ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের ২০০তম প্রদর্শনী হবে। এখন আমাকে বলা হচ্ছে, এই নাটকে যেন অভিনয় না করি। কারণ হিসেবে তিনি ছাত্র আন্দোলনের সময় দেওয়া ২৪ জন বিশিষ্টজনের একটি বিবৃতির কথা জানিয়েছেন।’’
মামুনুর রশীদ জানান, সাম্প্রতিক সময়েও তিনি শিল্পকলার মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তাহলে এখন কেন হঠাৎ তাকে নামানো হচ্ছে মঞ্চ থেকে? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে এই কিংবদন্তি বলেন, ‘‘সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকে অভিনয় করেছি, মহিলা সমিতির মঞ্চেও অভিনয় করেছি, তাতেও কোনও সমস্যা হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির অসুবিধার জায়গাটা কোথায়? অবশ্যই অসুবিধার একটা জায়গা আছে। কারণ হলো দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’ তারা বন্ধ করেছে, পরে এর প্রতিবাদ সভায় আমার ওপর হামলা করেছে। পরদিন আমাদের শো ছিল, কিন্তু তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। তখন থেকেই এই কথাগুলোর সূচনা হলো, আমি যদি অভিনয় করি তাহলে হামলা হবে।’’ শিল্পকলায় মামুনুর রশীদের অভিনয় করা থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘‘আমি মামুনুর রশীদকে নিজে ফোন করে তাদের ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের শো করতে বলেছিলাম। এই নাটকটি করা দরকার। এই নাটকে উনি ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তাকে অনুরোধ করেছি, ‘সেই চরিত্র যদি অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায়। কারণ, আপনি যেহেতু আন্দোলনের সময় রাজাকার নিয়ে কিছু বলেছিলেন, এটা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, কষ্ট আছে। আপনি গেলে মানুষের সেই কষ্টটা বাড়বে। সেই জন্য আপনি ছাড়া যদি নাটকটির প্রদর্শনী সম্ভব হয়, এটা আপনি দেখেন’।’’
যদিও সৈয়দ জামিল আহমেদের এই সরল ভাষ্যকে সরলভাবে নিতে পারেননি মামুনুর রশীদ। এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার কোনও অপরাধ নেই, অথচ আমাকে অভিনয় করতে দেবে না। রাজাকার স্লোগান নিয়ে ২৪ জন বিশিষ্টজন বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেখানে আমার নাম ছিল। ওই বিবৃতিতে কী অপরাধ আছে? এখন তো বলা হচ্ছে আপনারা কথা বলেন। সেই কথাই বলতে পারবো না? এমন একটা সময় চলে এসেছে এই বাংলাদেশে, একটি মহল তো চাচ্ছেই শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যাক। আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি, ‘রাঢ়াঙ’ আমরা করবো না, ‘কম্পানি’ও করবো না। চলুক যত দিন এই ব্যবস্থা চলে।’’
মঞ্চের এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে ফুঁসে উঠেছে মঞ্চ সংশ্লিষ্টদের অনেকেই। বেশিরভাগই হতাশা ব্যক্ত করছেন শিল্পকলা একাডেমির যোগ্য মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে। এ প্রসঙ্গে দেশ নাটকের অন্যতম কর্তা মাসুম রেজা বলেন, ‘‘গত ২ নভেম্বর দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল তা শিল্পকলার ডিজি তার দুই একজন সহকর্মীকে নিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলেছিলেন; ‘ছোট যুদ্ধে হেরেছি কিন্তু বড় যুদ্ধে হারবো না..।’ তাহলে বড় যুদ্ধটা কার সাথে? ছোট যুদ্ধটা তিনি কাদের সাথে হারলেন? তার কী কোনও খোঁজ খবর নিয়েছেন আপনারা? আমার বিশ্বাস ছিল তিনি সমস্ত বিষয়ে তদন্ত করে সকল থিয়েটার কর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। শিল্পকলায় আমাদের অবাধ বিচরণ ও কাজের পরিসর সুপ্রশস্ত করবেন। কিন্তু তা না হয়ে শিল্পকলার মঞ্চে মামুন ভাইকে অভিনয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা আসলো। আমার মনে হয়, যতদিন আপনি সকল থিয়েটার কর্মীর নিরাপত্তা বিধান এবং নির্ভয়ে কাজ করার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না, ততদিন আপনি শিল্পকলায় থিয়েটার বন্ধ রাখুন।’’ আরও: