এমনই হবে অনুমেয় ছিল। তবু চুক্তির অধিকারে কিংবা চাকরির টানে তিনি নিজের চেয়ারের কাছে গেলেন। বসতেও পারেননি ঠিকঠাক। একদল কর্মকর্তা-কর্মচারীর রোষানলে পড়ে ফিরতে হলো ঘরে, চোখে জল টলমল। বিদায়ের আগে সঙ্গে নিলেন অফিস কক্ষে যত্নে রাখা মায়ের ছবি, কিছু প্রিয় কসমেটিকস আর দরকারি স্যানিটারি প্যাড।
ঘরে ফিরে ভিডিও বার্তায় পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলেন। কাঁদলেন অঝোরে। প্রশ্ন রেখে গেলেন, ‘তাহলে কি এই দেশটা আমার নয়?’
অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি। গত সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে পরিচালক পদে বসেন তিনি। কাজ করছিলেন নিয়মিত, মন দিয়ে। ৫ আগস্ট পরবর্তী পতন পরিস্থিতিতে আর কর্মস্থলে ঢোকা হয়নি তার। তবে সম্প্রতি শিল্পকলায় নতুন মহাপরিচালক ও সচিব নিয়োগ হওয়ার সাহসে ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে নিজ কর্মস্থলে গেলেন জ্যোতি। রুমে ঢুকতেই পড়লেন হট্টগোলে। তোপের মুখে পড়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে বেরিয়ে যেতে হলো একাডেমি থেকে।
জ্যোতির ভাষায়, ‘পুরো শিল্পকলাজুড়ে চলছে হট্টগোল। তারা আমাদের কাউকে চাকরি করতে দেবে না। শিল্পকলায় ঢুকতে দেবে না। একের পর এক দরজায় তালা লাগাচ্ছিল। তারা বাইরের কেউ নন। শিল্পকলারই কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের দাবি, বিএনপি করেন। অথচ তারাই গত সরকারের আমলে আরাম করে চাকরি করেছেন। কেউ বাধা দেয়নি। অথচ এখন তারাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কে শিল্পকলায় ঢুকবে, কে বের হবে!’
নিজের অবরুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্যোতি জানান, ‘অনেকেই শুনেছেন আমাকে আটকে রাখা হয়েছে শিল্পকলায়। বিষয়টি ততদূর গড়ায়নি। এর মধ্যে মহাপরিচালক মহোদয় ও সচিব স্যার এসেছেন। আমি তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। কারণ আমি তো জানি না, চাকরিটা আছে কি নেই। এমন কোনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। আমার চুক্তিও শেষ হয়নি। তাহলে আমি কেন যাবো না? যাই হোক, স্যারদের সঙ্গে দেখা করার পর তারাও দেখলাম খানিক বিব্রত। বললেন, এমন পরিস্থিতিতে আপনি কেন এসেছেন? চলে যান। এরপর সচিব স্যারের সহযোগিতায় আমার রুমে গেলাম। বাইরে তুমুল হট্টগোল চলছে। মায়ের ছবি নিলাম, কিছু কসমেটিকস ছিল আর স্যানিটারি প্যাড, সেসব নিলাম। বের হওয়ার সময় বিপ্লবীদের দেখালাম সেগুলো, বললাম এগুলো আমার একান্তই নিজস্ব। শিল্পকলার নয়। চলে এলাম।’
হয়তো জ্যোতি মানহানি থেকে নিজেকে রক্ষা করে ফিরেছেন। কিন্তু মনের যে ক্ষতিটা হলো সেটি নিয়েই অঝোরে কাঁদলেন অভিনেত্রী। বারবার বলছিলেন, এই চাকরিটা আওয়ামী লীগের উপহার ছিল না। এটি তার একান্ত যোগ্যতায় হয়েছে। বললেন, ‘মিডিয়ার নানা সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাল না দিতে পেরে আমি তখন অভিনয়ে প্রায় বেকার হয়ে পড়েছি। বাধ্য হয়ে চাকরি খুঁজছিলাম। এরপর দুজন মানুষকে আমি আমার সিভি দিয়ে চাকরি চাই। তারপর এই চাকরির সুযোগটা পাই। দেশে যে এমন চুক্তিভিত্তিক চাকরি আছে, সেটাই আমি জানতাম না। এই চাকরিটা হয়েছে শতভাগ নিয়ম মেনে। আমার সার্টিফিকেট, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড সবকিছু ছয় মাস ধরে যাচাই-বাছাই করে এই চাকরিটা পেয়েছি আমি। অথচ সেই কর্মস্থলে আজ আমি ঢুকতে পারছি না!’
শেষে জ্যোতি কাঁদতে কাঁদতে সবার প্রতি একটা প্রশ্ন করেন। বলেন, ‘কাজ করার বয়স যখন থেকে হলো সেদিন থেকে আমি শ্রম-মেধা দিয়ে চলেছি নিজের জন্য, দেশের জন্য। কখনও দলীয় আরামে নিজেকে জড়াইনি। অভিনয়ে তিল তিল করে নিজেকে গড়েছি। পড়াশোনাটাও করেছি। চাইলেই তো আমি উন্নত দেশে সেটেল হতে পারতাম। হইনি। এখন চাকরিটাও হারালাম। অভিনয় শিল্পীদের মধ্যেও দেখছি একই অবস্থা, বিভাজন। ফলে অভিনয়টাও আর করতে পারবো না। তবে কি এই দেশে কেউ দল সমর্থন করবে না? কেউ হিন্দু হতে পারবে না? তাহলে কি এই দেশটা আমার নয়?’
বলা দরকার, অভিনয়ের পাশাপাশি গত এক দশকে জ্যোতিকা জ্যোতি খুলেছেন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। গড়েছেন শস্যপণ্য বিপণন প্রতিষ্ঠান। চেয়েছেন গৌরিপুর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। তবে শেষে এসে গত বছর থিতু হয়েছেন মূলত শিল্পকলা একাডেমিতে। গত বছরের (২০২৩) ১৩ মার্চ থেকে তিনি দুই বছরের চুক্তিতে একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন।