তুষ্টি মনে করছেন, বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যে অনেকাংশে ভুল করেছেন, সেই উপলব্ধি আগেই হয়েছিলো। তবে সেটি প্রকাশে বিলম্ব করেছেন কিংবা সুযোগ ও সাহস পাননি। তাই ৫ আগস্ট বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতির পরও সেই উপলব্ধি প্রকাশ করতে আরও ৩২ দিন সময় নিয়েছেন। ৭ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে দীর্ঘ এক উপলব্ধি ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এই নেত্রী।
যারা এখনও স্পষ্ট নন কে এই তুষ্টি কিংবা কিসের উপলব্ধি বা অসন্তুষ্টি! তাদের সুবিধার্থে বলা দরকার, শামীমা তুষ্টি মূলত একজন অভিনেত্রী। তার গর্ব মুক্তিযোদ্ধা পিতা। বেড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক আদর্শে। দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমেও তিনি যুক্ত। তবে সাবলীল অভিনয়ে বরাবরই তিনি নিজেকে ছাপিয়েছেন রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। যদিও, জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে সচল ভূমিকা পালন করেছেন এই অভিনেত্রী। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে তার নিন্দাও ভোগ করছেন তিনি। এসব মিলিয়েই পরাজয় মেনে নিয়ে নিজের অবস্থান ও উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন তুষ্টি।
শুরুতেই তিনি প্রকাশ করেছেন, এই প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে ‘গালি’ ও ‘ট্রোল’ আশংকার কথা। বলছেন, ‘তবুও আমি আমার অবস্থান ক্লিয়ার করতে চাই। আমি প্রথমেই বলে নিতে চাই যে, আমি একটা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী। এটার কারণ আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এবং ১৯৬৫ সালে বাবা মালিবাগ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন, তাই আমার বাড়িতে সবসময় এই পরিবেশই ছিল, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আমি আমার নিজের পক্ষ ভেবেছি। আমার এই পক্ষপাতিত্ব যে ভুল তাও আমি মনে করি না। আমি মনে করি, আমি আমার অংশগ্রহণ ঠিক বিবেচনা করেই করেছি।’
এ পর্যন্ত তুষ্টি স্পষ্ট ভাষায় নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেছেন, তিনি যে দলের সমর্থক বা কর্মী সেটি তিনি জেনে-বুঝেই করেছেন। সেটি যে সঠিক ছিলো, সেটাও তিনি মনে করেন। তবে পরের অংশে তিনি কিছু বাস্তবতার কথাও প্রকাশ করেন। বোঝানোর চেষ্টা করেন, একটি দল করতে গেলে তার কিছু নির্দেশনাও মেনে চলতে হয়। অর্থাৎ সেখানে ব্যক্তির ইচ্ছার চেয়ে দলের সিদ্ধান্তটাই আসল।
তুষ্টির ভাষায়, ‘দলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমার নিজের কিছু বিচার-বিবেচনা আছে। আপনারা সকলেই জানেন, কেউ যদি কোনও দলের কর্মী হিসাবে কাজ করে, তখন তার সেই দলের নেতাদের কথামতো কাজ করতে হয়। সেসব দলীয় নির্দেশনার বিপক্ষে গিয়ে কাজ করার পরিস্থিতি থাকে না। এবং আমি তা করতেও চাই না দলের কর্মী হিসাবে। তাই বলে এই হত্যাকাণ্ড, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এই নৃশংসতার আমি সমর্থক নই। এক মিনিটের জন্যও ছিলাম না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বহু কর্মীই তা ছিলেন না। আমাদের অনেকেরই পজিশন নেয়া দরকার ছিল। অনেক আগেই দরকার ছিল। আমি জানি, আপনাদের অনেকে এই কথাতেও ক্ষুব্ধ হবেন। কিন্তু আশা করি এটা মানবেন যে, আমরা বাংলাদেশে কী ঘটছে তাও জানতে দেরি করেছি। দলীয় রাজনীতির মধ্যেও খবর ফিল্টার হয়।’
তবুও তুষ্টি চেষ্টা করেছেন হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থার নেওয়ার, এটা তার দাবি। যদিও সোশ্যাল হ্যান্ডেলে তার কোনও ছায় মেলেনি কখনও। বরং শিল্পী কমিউনিটির মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে ছিলেন এই অভিনেত্রী। এটাও ঠিক, সোশ্যাল হ্যান্ডেল থেকে তো আর মানুষের ভেতরটা পুরোপুরি পড়া সম্ভব নয়। যেটি তার এখনকার উপলব্ধিতে প্রকাশ হয়েছে।
তুষ্টি বলেন, ‘যার সন্তান গেছে তার অবস্থা ভেবেছি। প্রতি মুহূর্তে আমি, আমাদের কেউ কেউ, একটা পজিশন নিতে গেছি। সেসব পজিশন কারও না কারও কারণে অন্য আরেকটা পজিশন হয়ে গেছে। আমরা বিটিভিতে গেছি, শিল্পীরা সহিংসতা ও ছাত্রদের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন। করেছেনও, তবে সেটা সংবাদে তেমন করে আসেনি, কিন্তু যা এসেছে তাতে আরও ভুল বোঝার জায়গা তৈরি হয়েছে। তবে যা দেখা গেছে সেটাও ঠিক না, তা আমি বলবো না। আমরা হাসপাতালেও আহতদের দেখতে গেছি। আর তখনও আমি সকল কিছু বুঝে উঠতে পেরেছি তেমন না।’
তখন সরকার বা দলের কেন্দ্র থেকে কী হচ্ছে সেটি থেকে অনেকটাই অন্ধকারে ছিলেন তুষ্টি। ফলে অনেক সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি। অভিনেত্রী মনে করেন, এত দ্রুত সব ঘটে যাচ্ছিলো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না তখন। তার ভাষায়, ‘আমরা যে যাই ভাবি না কেন, দল মূলত কি কি করতে যাচ্ছে বা কি করবে, তা সম্পূর্ণ জানার উপায় আমাদের ছিল না। আমি এসব কথা বলে পক্ষবদলের চেষ্টা করছি না। বরং আমার দলের পক্ষে যেসব মারাত্মক ভুল ছিল, আমার যে সব বোঝাবুঝি ছিলো সেগুলোর কারণে আমার দোনোমনা আর পরিস্থিতির কথা আপনাদের জানাতে এসেছি। আমি একটা সংগঠন করি যেখানে সিংহভাগই এই হিংস্রতা, এই হত্যার সমর্থক নয়। কিন্তু আমাদের কোনও একটা পজিশন কীভাবে নিতে পারি, তা ভাবতে ভাবতেই প্রতিদিন আরও নতুন মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন আরও বেশি করে আপনাদের থেকে দূরে সরে গেছি।’
বাদ রাখলেন না সর্বশেষ সর্বাধিক আলোচিত ‘আলো আসবেই’ গ্রুপ নিয়েও। ‘আমি একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছিলাম। সেখানেও আমি বলেছি যে, সকলের সাথে গিয়ে আলাপ করতে হবে। এগুলো বন্ধ করা দরকার। কিন্তু ঘটনা এত দ্রুত ঘটছিল, আমি যা সমর্থন করি না তা আপনাদের জানানোর সুযোগ পাইনি। তাছাড়া আমার অনেক সহকর্মীরাও এসবের ভেতরে ছিলেন, পরে হয়তো থাকেননি। তারাও আমাকে অনেক গালাগাল করেছেন, তবু আমি বলতে চাই যে আমি আমার সহকর্মীদের জন্য অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছি। এখনও তাই করবো। এছাড়াও আমরা আমাদের সিনিয়র সহকর্মীদের সাথেও যোগাযোগ করতে পরিনি সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য। সেসবও আমাকে ভাবিয়েছে।’ যোগ করলেন তুষ্টি।
জানালেন ৫ আগস্টের পরেও ৩২ দিন সময় নিলেন কেন আত্মপক্ষ সমর্থন প্রকাশে। এটাও জানালেন, তার এই উপলব্ধি দলবদলের আশায় নয়। তার ভাষায়, ‘এখনও আপনাদের সামনে এসে কথা বলতে দেরি করেছি। যে ঘৃণার সম্মুখীন আমরা, যে গালাগালি আমি খেতে পারি সেসবের ভয়েই আরও আরও দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু আমি নিজেকে বুঝিয়েছি, এইসব সমালোচনা আর গালি আর ট্রোল আমার গ্রহণ করতে হবে। আর সেসবের মধ্য দিয়েই শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। আপনারা দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি দলবদলের ইচ্ছা থেকে আসিনি। আমি যে দলে ছিলাম সেই দলের নেতৃবৃন্দের সকল কার্যক্রম যে আমি সমর্থন করি না, সেটা জানাতে এসেছি। আমি জানাতে এসেছি আমি দল করলেও নিজের বিচারবুদ্ধি বিবেক-বিবেচনা বিক্রি দিয়ে দল করি না। আমি অনেক দেরিতে আপনাদের সামনে এসেছি। কিন্তু আমার অনুভূতি নতুন নয়। শুরু থেকেই হচ্ছিল। আমি সত্যি সত্যি ট্রোল-গালির ভয়ে আগে লিখিনি। অনেক ট্রোল আর গালি নেবার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলাম না। এখন কিছুটা নিজেকে সংযত করতে পেরেছি। সহ্য করার মতো ধৈর্য আশা করি আমার হবে, আপনাদের সকল কথা নেবার। সেরকম জায়গা থেকেই আমার অবস্থান আমি আপনাদের কাছে পরিষ্কার করলাম।’
শেষে বলেন, ‘আমি সকলের মঙ্গল কামনা করছি। শহীদদের আত্মত্যাগ যেন বাংলাদেশে বিফলে না যায় সেই প্রত্যাশা করছি।’