অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান উপলক্ষ পেলেই ছুটে আসেন সিনেমার উৎসবে। সংগীতটাকে যে তিনি সিনেমার সুতোয় বেঁধে সুগন্ধি এক মালা বানিয়ে রেখেছেন বিশ্বজুড়ে। ফলে সিনেমার উৎসব হলেও তাকে ঘিরে উন্মাদনা কিংবা আগ্রহের খামতি থাকে না। যেমনটা ছিল না এবারের কানসৈকতেও। ৭৭তম আসরে এই গ্র্যামিজয়ী সংগীত পরিচালক এসেছেন সিনেমার প্রযোজক পরিচয়ে। যে ছবির পুরো সংগীত বানিয়েছেন নিজেই, যার মাধ্যমে তিনি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চান অস্থির নাগাল্যান্ডের শান্তির বার্তা। ১৯ মে কানসৈকতে ব্যস্ত সময়ের খানিকটা দিলেন বাংলা ট্রিবিউন-কে। মন খুলে বললেন বাংলা গান, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকন্যাসহ নানা প্রসঙ্গে...
বাংলা ট্রিবিউন: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দুটি গান করেছেন আপনি। যেটি লিখেছেন বাংলা ট্রিবিউন সম্পাদক জুলফিকার রাসেল। এই দূর কানসৈকতে বসে গান দুটি করার অভিজ্ঞতা তথা বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে খানিকটা জানতে চাই।
এ আর রাহমান: গান দুটি তৈরি করতে আমার অনেক ভালো লেগেছে। খুব এনজয় করেছি পুরো বিষয়টি। বাংলাদেশে আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। এমনকি আমি যখন লন্ডনে যাই, সেখানেও বাংলাদেশের অনেক মানুষ পাই, যারা আমার কাজ পছন্দ করেন।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার সঙ্গে তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা হয়েছে। ২০২২ সালে ঢাকায় গিয়েছিলেন...
এ আর রাহমান: ইয়েস। আই মেট (সাক্ষাৎ) শেখ হাসিনা-জি। তিনি আমাকে অসম্ভব সুন্দর একটি পারফিউমের বোতল উপহার দিয়েছেন। বেশ বড়। সেটি এখনও আমার কাছে আছে এবং ব্যবহার করি নিয়মিত। অ্যান্ড ইট ইজ আ গ্রেট এক্সপেরিয়েন্স ফর মি।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রশ্নটি হয়তো দামি নয়। তবু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে, বাংলা গান আপনি শোনেন? নাকি কোনও কাজের সুবাদে শোনা হয়।
এ আর রাহমান: আমি বাংলা ভাষা বেশ পছন্দ করি। কারণ মিউজিক্যালি বিবেচনা করলে এই ভাষাটাকে আমার কাছে শ্রুতিমধুর মনে হয়। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত, লালন ফকির আমার শোনা হয়েছে বেশ।
বাংলা ট্রিবিউন: রবীন্দ্র বা লালনের গান থেকে কি আপনি নতুন সৃষ্টিতে উৎসাহ খুঁজে পান?
এ আর রাহমান: আমি কিন্তু লালন ফকিরের গান নিয়ে গবেষণা করেছি। প্রায় বছর দশেক আগে আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি ভারত কিংবা এই অঞ্চলের গানের ভেতর লোকধারা বা আধ্যাত্মিকতার রেশ। সেটি খুঁজতে গিয়ে আমি লালন ফকিরকে শুনি। অসাধারণ লেগেছে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ সংগীত জীবনে অনেক ভাষার সিনেমায় গান করেছেন। এখনও করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তৈরি দুটি গানের বাইরে বাংলা ভাষায় আর কোনও গান করেছেন বা সামনে করার পরিকল্পনা আছে?
এ আর রাহমান: করেছি তো! মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’-এ। ঢাকা, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কিন্তু নিয়মিত। এর আগে নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশের রিয়াঞ্জলি ভৌমিকের সঙ্গে কাজ করেছি। কোক স্টুডিওর জন্য একটা রবীন্দ্রসংগীত অ্যারেঞ্জ করেছি। সামনে নিশ্চয়ই বাংলা গান নিয়ে আরও কাজ করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: একটি নজরুলগীতিও আপনি করেছেন সম্প্রতি বলিউডের ‘পিপ্পা’ সিনেমার জন্য। যেটি নিয়ে দুই বাংলায় চরম বিতর্কও হয়েছে...
এ আর রাহমান: দেখুন, বিষয়টি কিন্তু সলভ হয়েছে। সেটি এতদূরে এসে আবার তুললেন নতুন করে। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমরা কিন্তু গানটি তৈরি করেছি যথাযথ আইন ও নিয়ম মেনে। এরপর সেটি থেকে যেমন ভালো প্রতিক্রিয়া পেয়েছি শ্রোতাদের, তেমনি কিছু অস্বস্তির কথাও আমরা শুনেছি। তবে সেই বিষয়টি এর মধ্যে স্পষ্ট ও সমাধান হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: সামনে আর কোনও বাংলা গান করার কথা রয়েছে? সেটা কলকাতা বা বাংলাদেশ, নজরুল বা রবীন্দ্র- যাই হোক না কেন।
এ আর রাহমান: ওহ.. রিয়েলি, উই নেভার নো। স্রষ্টা জানেন ভালো। আমি শুধু পাল্টা প্রশ্ন করতে পারি, ‘হোয়াই নট?’।
বাংলা ট্রিবিউন: কান উৎসবে আপনি প্রায় নিয়মিত আসেন। সেটি যৌক্তিক কারণেই। তবু প্রশ্ন, আপনি কি মনে করেন এই উৎসবটি সিনেমার শিল্পী-কুশলীদের মতোই মিউজিশিয়ানদের জন্যও ততটা গুরুত্বপূর্ণ?
এ আর রাহমান: আমি মনে করি এটা সবার জন্যই ইনস্পায়ারিং একটি আয়োজন। সবাই আসছেন, দেখছেন, কথা বলছেন, আনন্দ করছেন। এক কথায় এটা একটা সুখময় স্থান বলে মনে হয় আমার। সেটি ছাড়াও আমি সিনেমা উৎসব বরাবরই পছন্দ করি। এসব উৎসবকে বরাবরই মনে হয় সিনেমা ও সংগীতের মেধাবী মানুষগুলোর মধ্যে আদান-প্রদানের অন্যতম আয়োজন। সেজন্য সুযোগ পেলেই আমি বিশ্বের বিভিন্ন সিনেমা উৎসবে যাই। কান উৎসব সে হিসেবে আমার আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: এবারের উৎসবে আপনি সংগীত পরিচালক পরিচয়ের বাইরেও এসেছেন সিনেমার প্রযোজক হিসেবে। আপনাকে অভিনন্দন। আপনার ছবিটির নাম ‘হেডহান্টিং টু বিটবক্সিং’। এটা মূলত ভারতের অস্থির নাগাল্যান্ড রাজ্য নিয়ে নির্মিত। এ সম্পর্কে একটু জানতে চাই।
এ আর রাহমান: নাগাল্যান্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা ভয়ংকর ছিল। প্রায় ৪০ বছর ধরে আমরা শুনে আসছি, ওখানে যেও না। গেলে মাথা কেটে রেখে দেবে! কথাটি একটা সময় অনেকটাই সত্যি ছিল। কিন্তু সেটি এখন অদ্ভুত একটা শান্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সেখানে গেলে আপনি একটা মিউজিক্যাল পরিবেশ পাবেন। তো এই বিষয়টি নিয়েই আমাদের এই সিনেমা। ইটস আ মিউজিক্যাল ফিল্ম। যেখানে পপ, রক, ফোক, জ্যাজ, ব্লুজসহ এমন অনেক ধরনের মিউজিক্যাল আবহ রাখার চেষ্টা করেছি। সঙ্গে অন্যরকম এক নাগাল্যান্ড আর ভয়ংকর ইতিহাসের ছায়াও থাকছে সিনেমাটির স্ক্রিনপ্লেতে।
বাংলা ট্রিবিউন: এবার একটু সিনেমার বাইরের প্রসঙ্গ। আপনি অস্কার আর গ্র্যামির মতো বিশ্ব-শীর্ষ স্বীকৃতি পাওয়া মিউজিশিয়ান। এই যে স্বীকৃতি, সেটি আপনার নতুন সৃষ্টি বা সুরের ক্ষেত্রে কখনও কি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মানে ইউ ফিল প্রেসার?
এ আর রাহমান: সংগীত আসলে আমাকে বা আপনাকে প্রেসার দেবে না। বরং প্রেসার কমায় বলেই আমার ধারণা। ইটস অল অ্যাবাউট ফিল অ্যান্ড সোল। মূল কথা হচ্ছে আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি। আমি মনে করি প্রতিটি সুর আমার জন্য আশীর্বাদের মতো। এবং সেই আশীর্বাদ নিজের মধ্যে না রেখে মিলিয়ন মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াটাই উচিত বলে বিশ্বাস করি। শুরু থেকে সেটিই করছি আনন্দ নিয়ে। এখানে প্রেসার বলে কিছু নেই।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি বলিউড, তামিল, তেলুগু থেকে শুরু করে হলিউডেও কাজ করছেন নিয়মিত। সফলতাও সেই মাফে ফিরছে ঘরে। কাজ করতে গিয়ে আসলে কোন ইন্ডাস্ট্রিকে আপনার জন্য আরামদায়ক বা আনন্দদায়ক বলে মনে হয়েছে।
এ আর রাহমান: সব সুর বা গানই তৈরি করি মানুষের জন্য। ফলে এখানে অঞ্চল বা ইন্ডাস্ট্রির বিবেচনায় ভালো বা মন্দ বিবেচনা করি না। দিনশেষে সবাই মানুষ। এটা ঠিক নিজের দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে গেলে বেশি গর্ববোধ করি। একইভাবে হলিউড থেকে যখন কাজের প্রস্তাব পাই বা কাজ করি, তখনও বেশ গর্ব হয়। কারণ তারাও আমাকে ভালোবেসে মিউজিক করার জন্য ডাকেন।
বাংলা ট্রিবিউন: শেষ জিজ্ঞাসা। সরল জিজ্ঞাসাও বলতে পারেন। সিনেমা বিশ্বে কাজ করছেন লম্বা সময়। জনপ্রিয়তা আর খ্যাতি আপনার হাত ধরে পাশাপাশি চলছে এখনও। জানতে চাওয়া, অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছেন কখনও!
এ আর রাহমান: প্রস্তাব পেয়েছি। তবে অভিনয় করবো না, এটুকু নিশ্চিত। কারণ অভিনয় করলে মিউজিকে ফোকাস নষ্ট হবে। সেটি আমি চাই না।
বাংলা ট্রিবিউন: অসংখ্য ধন্যবাদ এতটা সময় দেওয়ার জন্য। শুভকামনা আপনার নতুন সিনেমাটির জন্য। কানসৈকত থেকে বাংলাদেশকে কিছু বলুন প্লিজ...
এ আর রাহমান: (বাংলায় বললেন) সোনার বাংলা, আই ওয়ান্ট টু ভালোবাসি! লাভিউ।
সাক্ষাৎকার সমন্বয়ক: জনি হক, কান (ফ্রান্স)