২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এলএ উইকলি’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা একটি তালিকা প্রকাশ করে; সর্বকালের সেরা গায়কদের তালিকা। সেখানে চতুর্থ স্থানে যার নামটি ছিল, তিনি নুসরাত ফতেহ আলি খান। পাকিস্তানের কিংবদন্তি গায়ক, গীতিকবি ও সংগীত পরিচালক। মূলত কাওয়ালি গানের জন্যই তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাকে বলা হয় ‘শাহেনশাহ-এ-কাওয়ালি’ বা কাওয়ালির রাজাদের রাজা।
আজ শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) কালজয়ী এই সংগীত ব্যক্তিত্বের জন্মদিন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্যের ফয়সালাবাদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
নুসরাত ফতেহ আলি খানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এমন এক পরিবারে, যেখানে কাওয়ালির চর্চা হচ্ছে দীর্ঘ ছয় শতাধিক বছর ধরে। বলা বাহুল্য, এমন ঐতিহ্যবাহী পরিবার পৃথিবীতে বিরল। নুসরাত যেমন তার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে কাওয়ালি পেয়েছেন, লালন করেছেন, সেই পথ ধরে তার উত্তরসূরিরাও এই সংগীতে মিশে আছেন।
কাওয়ালি মূলত উপমহাদেশীয় সংগীত। তবে এটিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার কাজটি করেছিলেন নুসরাত ফতেহ আলি খান। জীবদ্দশায় তিনি বহু আন্তর্জাতিক শো করেছেন। তার নাম-কণ্ঠের মাধ্যমে কাওয়ালি ছড়িয়ে গেছে পশ্চিমা বিশ্বেও। তার সম্পর্কে বলা হতো ‘আ ভয়েস ফ্রম দ্য হ্যাভেন’। তিনি যে স্কেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গাইতেন, তা এখনও এক বিস্ময়।
নুসরাতের বাবা ফতেহ আলি খানের ইচ্ছে ছিল, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, সচ্ছল ক্যারিয়ার গড়বে। কারণ, ওই সময়ে কাওয়ালির খুব একটা কদর ছিল না, আয়-রোজগারও ছিল সামান্য। কিন্তু ছেলের গলায় যে আজন্ম সুর বেঁধে ছিল, তাকে কি দমিয়ে রাখা যায়! ঠিক তা-ই, নুসরাতের অদম্য আগ্রহের জেরেই বাবা তাকে কাওয়ালির দীক্ষা দেন। আর একসময় সেই পুত্রই তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে পরিবারের ঐতিহ্য তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে গিয়ে গান করেছেন এই নন্দিত শিল্পী।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথমবার মঞ্চে গান পরিবেশন করেন নুসরাত ফতেহ আলি খান। ১৯৭১ সালে তিনি তাদের পারিবারিক কাওয়ালি দলের প্রধান হয়ে ওঠেন। ‘হক আলি আলি’ গান দিয়ে তার জনপ্রিয়তার সূচনা। পরবর্তীতে তার কণ্ঠে ‘মেরে রাশকে কামার’, ‘তুমহে দিল্লাগি’, ‘সোচতা হু কে’, ‘মাস্ত মাস্ত’, ‘হক আলি আলি’, ‘দামা দাম মাস্ত’, ‘রেহমাত কা ঝুমার’ ইত্যাদি গান জনপ্রিয়তা লাভ করে। এমনকি এসব গান বর্তমান প্রজন্মের শিল্পী-শ্রোতাদের কাছেও সমান জনপ্রিয়।
কাওয়ালি বলতে যখন সবাই স্থানীয় আয়োজনের অংশ মনে করতো, তখন সেই সংগীত দিয়ে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পর্যন্ত পেয়েছিলেন নুসরাত ফতেহ আলি খান। ১৯৯৭ সালে তার ‘ইনটক্সিকেটেড স্পিরিট’ অ্যালবামটি গ্র্যামিতে সেরা ট্র্যাডিশনাল ফোক অ্যালবাম ক্যাটাগরিতে এবং তার গাওয়া ‘নাইট সং’ অ্যালবামটি সেরা ওয়ার্ল্ড মিউজিক অ্যালবাম ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়।
এছাড়া ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো মিউজিক প্রাইজ, ২০০১ সালে ‘সবচেয়ে বেশি কাওয়ালি রেকর্ডিং’র (১২৫টি) জন্য গিনেজ বুকের স্বীকৃতিসহ বহু দেশি-বিদেশি সম্মাননা পেয়েছেন নুসরাত ফতেহ আলি খান।
স্থূলকায় মানুষ ছিলেন নুসরাত ফতেহ আলি খান। শোনা যায়, তার ওজন ছিল ১৩৫ কেজি। অতিরিক্ত ওজনের কারণে তার শরীরে নানাবিধ রোগ বাসা বাঁধে। ১৯৯৭ সালে কয়েক মাস ধরে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন নুসরাত। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন লন্ডনে। কিন্তু সেখানেই ১৬ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। তবে তিনি চলে গেলেও তার ভাতিজা রাহাত ফতেহ আলি খান, রিজওয়ান ও মুয়াজ্জম সংগীতের চর্চা জারি রেখেছেন।