রাজধানীর মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক জিনাত ফারহানার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, আর্থিক দুর্নীতির পর এবার শিক্ষক হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন অনিয়ম থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বিগত সরকারের সময়। এমনকি গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিপাশা ইয়াসমিনকে স্কুলের কক্ষে আটকে রেখে হেনস্তা করেন তিনি। সেনাবাহিনীর সহায়তায় ওই শিক্ষক মারধরের হাত থেকে রক্ষা পান।
অভিযোগ মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের টিসি দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক জিনাত ফারহানা। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে তা প্রতিহত করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক বিপাশা ইয়াসমিন জানান, তিনি ও অন্যান্য শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, জেলা প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দিয়েছেন। বিপাশা গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিপাশা ইয়াসমিন তাকে হেনস্তার অভিযোগে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাও দায়ের করেছেন।
বিপাশা ইয়াসমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাকে গত ৫ সেপ্টেম্বর স্কুলের একটি রুমে আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়। আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়, দুই ঘণ্টা পর শিক্ষকরা উদ্ধার করে। আমাকে শুধু হেনস্তা করেই চুপ থাকেননি জিনাত ফারহানা। আবারও হুমকি দিয়েছেন স্কুলে না যেতে। আমি আগামী রবিবার স্কুলে যাবো। শুধু আমি না, তার ভয়ে শিক্ষকরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না।’
সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল নাঈম মিলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জিনাত ফারহানা সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। হঠাৎ একদিন শুনি তিনি প্রধান শিক্ষক। জানতে পারি, প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে গোপনে যাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে তারা সবাই আমাদের স্কুলের শিক্ষক। জিনাত ফারহানাকে পরীক্ষায় প্রথম দেখানো হয়েছে। এভাবে হঠাৎ করেই তাকে প্রধান শিক্ষক করা হয়। ইচ্ছামতো ম্যানেজিং কমিটি তৈরি করে শিক্ষা বোর্ডকে দিয়ে অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন দুর্নীতি করেছেন জিনাত ফারহানা। ২০১৮ সালে রেজুলেশন ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনিয়ম করলেও তার ভয়ে শিক্ষকরা কিছুই বলতে পারেন না। গত ৫ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক বিপাশা ইয়াসমিনকে মারধর করেন। শিক্ষকদের ইট দিয়ে মারার জন্য হুকুম দেন। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করা হয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক জিনাত ফারহানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমিসহ ১৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বিপাশা ইয়াসমিন। নন-এমপিও একজন শিক্ষক কেন এমনটা করছেন, তার শক্তি কোথায়, আপনাদের খোঁজ করে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি বিপাশা ইয়াসমিনকে হেনস্তা করিনি। তাছাড়া অন্য যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা বিদ্যালয়ে এসে যাচাই করে দেখার অনুরোধ করছি।’
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ও বিভিন্ন সংস্থায় করা লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের দিন সহকারী শিক্ষক বিপাশা ইয়াসমিনকে প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষে আটক রেখে হেনস্তা করেন প্রধান শিক্ষক জিনাত ফারহানা ও তার পক্ষের শিক্ষকরা। আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের পর পরবর্তী ১৬ দিন তিনি বিদ্যালয়ে আসেননি। এই সময়ের মধ্যে হেনস্তার ঘটনায় গত ১১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক বিপাশা ইয়াসমিন আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন। ঢাকা সিএমএম আদালত ওই দিনই মিরপুর মডেল থানাকে অভিযোগটির বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন।
বিপাশা ইয়াসমিন জানান, মামলার পর বিদ্যালয়ে ফিরে প্রধান শিক্ষক সাক্ষীদের হুমকি দিচ্ছেন। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় থেকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন তিনি।
আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে বলা হয়, ভুয়া টেন্ডার ও ভাউচার তৈরি করে খেলার মাঠ উন্নয়নের নামে মাটি ভরাট করে ১৯ লাখ ২৫ হাজার ৮২ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। অথচ এতে খরচ হতো সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা। প্রধান শিক্ষক অন্য একজন শিক্ষককে নিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর জন্য বিনা টেন্ডারে খরচ করেন ১০ লাখ টাকা, যা এক লাখ টাকায় করা যেতো। প্রতিষ্ঠানের একটি সভাকক্ষে, টয়লেটে ও ২০টি জানালার পর্দা তৈরিতে খরচ দেখিয়েছেন ৮ লাখ টাকা। ভবনের ছয়তলার একটি রুমে পার্টিশন ও সংস্কার কাজে ব্যয় দেখিয়েছেন ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য উন্নয়ন কাজে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
প্রতি মাসে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা কোচিং ফি আদায় করে আত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে জিনাত ফারহানার বিরুদ্ধে।
বিপাশা ইয়াসমিন আরও জানান, প্রধান শিক্ষক জিনাত ফারহানা গত সরকারের সময় থেকেই এখন পর্যন্ত কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই অনিয়ম করে যাচ্ছেন। রেজুলেশন ছাড়াই সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন।
তবে অভিযোগের সব বিষয় প্রধান শিক্ষক জিনাত ফারহানা অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে।