X
মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪
১৮ আষাঢ় ১৪৩১
সুনামগঞ্জে বন্যা

পানিতে ভেসে গেলো ১১৬ কোটি টাকার মাছ ও কৃষি

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
৩০ জুন ২০২৪, ০৮:০১আপডেট : ৩০ জুন ২০২৪, ০৮:০১

সুনামগঞ্জে এবারের বন্যায় অন্তত আট হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ৭২ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন পাঁচ হাজার চাষি। পাশাপাশি এক হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ও ৪২৫ হেক্টর সবজি ক্ষেত পানিতে ডুবে আট হাজার ৪০০ কৃষকের ৪৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছেন কৃষক ও মাছ চাষিরা।

বন্যায় মাছ ভেসে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন জানিয়ে সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের চাষি রবীন্দ্র রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘১৮ জুন রাতে তিন ঘণ্টার মধ্যে আমার ২০টি পুকুর ডুবে ৪০ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। চারপাশে জাল দিয়ে ঘিরে রেখেও কোনও লাভ হয়নি। চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গেলো।’

একই এলাকার চাষি আব্দুল করিম বলেন, ‘১৮ জুন রাত ৩টার দিকে পানি বেড়ে ৫টা পুকুর ডুবে সব ভেসে যায়। এতে পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

মাছ ভেসে যাওয়ায় ৭২ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন পাঁচ হাজার চাষি

সুরমা ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের মাছ চাষি আশিষ রহমান বলেন, ‘খাসিমারা নদীর স্রোতে আলীপুর, টেংরাটিলা, বৈঠাখাই, নোয়াপাড়া, রসরাই, সুলতানপুর, টেবলাই ও লামাসানিয়াসহ ২৫ গ্রামের তিন শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। রুই, কাতলা ও পাঙাশসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল। জাল দিয়েও আটকাতে পারেননি চাষিরা। ফলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’ 

এত দ্রুত ঢলের পানি এসে লোকালয়সহ সব পুকুর ডুবে যাবে কল্পনাও করতে পারিনি জানিয়ে আলীপুর গ্রামের মাছ চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে সব মাছ ভেসে গেছে। নতুন করে মাছের পোনা কেনার টাকা নেই। সরকারি সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে নতুন করে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর আছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদফতরের অধীন ২০টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। মাছ চাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। বন্যায় প্রায় আট হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ চার হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া মাছের খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে ৭২ কোটি টাকার। এর মধ্যে অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকার। 

এক হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ও ৪২৫ হেক্টর সবজি ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে

সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার চাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছেন বলে জানালেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বন্যায় আট হাজার পুকুরের চার হাজার মেট্রিক টন মাছ ভেসে পাঁচ হাজার চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন দোয়ারাবাজারের চাষিরা। কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দিরাইয়ের চাষিরা। সব মিলিয়ে মৎস্য খাতে ৭২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত চাষিদের কোনও সহযোগিতা দেওয়া যায়নি। আমরা প্রতিবেদন তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়েছি। কোনও সহযোগিতা, প্রণোদনা এলে মাছ চাষিরা পাবেন।’

দোয়ারাবাজার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুষার কান্তি বর্মন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দোয়ারাবাজারের মাছ চাষিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখানে এক হাজার ৬০০টি পুকুরের ২৪ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এতে ৮৭১ জন চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পুকুরের অবকাঠামো ভেঙে ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিন লাখ টাকার জাল, রশি ও নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত চাষিদের সহায়তা দেওয়া হয়নি।’

বন্যায় আউশের বীজতলার সর্বনাশ হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছেন দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আনগাং গ্রামের কৃষক আলী হোসেন। ক্ষতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৬ শতাংশ জমিতে আউশ ধান লাগানোর জন্য ১২ দিনের মধ্যে দুবার বীজ বুনেছি। দুবারই বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্তত তিন-চার হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখন তৃতীয়বারের মতো ধারদেনা করে বীজ বুনেছি। এখন যদি আবার বন্যা আসে তাইলে আর বীজ বোনার টাকা নেই। জমি পতিত থাকবে।’ 

একই গ্রামের কৃষক সাইদুল হক বলেন, ‘১৪ শতাংশ জমিতে আউশ ধান লাগানোর জন্য বীজতলা বুনে ছিলাম। দুবার বানের পানিতে ডুবে বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সুদের ওপর টাকা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বুনেছি। এখন যদি আবারও পানিতে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে জমি খালি পড়ে থাকবে। কারণ বীজতলা বুনতে বুনতে সব টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গেছে। ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ 

বন্যার পর নতুন করে বীজতলা বুনছেন চাষিরা

একই উপজেলার প্রতাপপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল আলী বলেন, ‘বন্যার পর সরকারি সহযোগিতা এলে ঠিকমতো বণ্টন হয় না। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নিজের মানুষকে সাহায্য করে। সাধারণ মানুষ সাহায্য পায় না।’ 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যার পানিতে এক হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ও ৪২৫ হেক্টর সবজি ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আট হাজার ৪০০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ ৪৪ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাঁচ কেজি করে বীজ ধান, ১০ কেজি করে এমওপি ও ১০ কেজি ডিএপি সার দেওয়া হবে।’

জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে ১২ উপজেলার এক হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় আট লাখ মানুষ। ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয় প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। গত কয়েকদিনে পানি নামায় দুর্গতরা আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িঘরে ফিরেছেন। বন্যায় জেলা সদরের সঙ্গে কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এখন সেগুলো স্বাভাবিক হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। নদী ও হাওরের পানি কমেছে।

/এএম/
সম্পর্কিত
বেড়েছে যমুনার পানি, নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত লোকজন
কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মিশছে হালদায়, মারা যাচ্ছে মাছ-ডলফিন
১৫ দিনের ব্যবধানে আবারও সুনামগঞ্জে বন্যা
সর্বশেষ খবর
বেড়েছে যমুনার পানি, নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত লোকজন
বেড়েছে যমুনার পানি, নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত লোকজন
ছাত্রলীগ নেতার হয়ে প্রক্সি দিতে এসে ধরা, ভুয়া পরীক্ষার্থীকে কারাদণ্ড
ছাত্রলীগ নেতার হয়ে প্রক্সি দিতে এসে ধরা, ভুয়া পরীক্ষার্থীকে কারাদণ্ড
দক্ষিণ কোরিয়ায় গাড়িচাপায় নিহত ৯
দক্ষিণ কোরিয়ায় গাড়িচাপায় নিহত ৯
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন: যৌক্তিকতা ও উচ্চশিক্ষার সুরক্ষার দায়িত্বশীলতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন: যৌক্তিকতা ও উচ্চশিক্ষার সুরক্ষার দায়িত্বশীলতা
সর্বাধিক পঠিত
কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবরে ‘ধন্যবাদ’ দিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব
কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবরে ‘ধন্যবাদ’ দিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব
সংবাদ প্রকাশের আগে যাচাইয়ের অনুরোধ করেছে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন
প্রতিবাদলিপির বিষয়ে বললেন এসবি প্রধানসংবাদ প্রকাশের আগে যাচাইয়ের অনুরোধ করেছে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন
জব্দ ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কীভাবে বিক্রি করলো সাদিক অ্যাগ্রো
অনুসন্ধানে দুদকজব্দ ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কীভাবে বিক্রি করলো সাদিক অ্যাগ্রো
গরু মাফিয়া: এতদিন কোথায় ছিলেন?
গরু মাফিয়া: এতদিন কোথায় ছিলেন?
সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিনোদন পার্ক করবে ডিএনসিসি
সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিনোদন পার্ক করবে ডিএনসিসি