দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভবেশ চন্দ্র রায়ের (৫৫) মৃত্যুর তিন দিন পর মুখ খুলেছেন স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, সুদে নেওয়া টাকা সময়মতো ফেরত দেওয়ার পরও দাবি করে আসছিলেন দাদন ব্যবসায়ীরা। সেটিকে কেন্দ্র করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পিটুনির পর ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে। ভয়ে এতোদিন মুখ খোলেননি তারা। এখন হত্যাকাণ্ডের বিচার চান, সেইসঙ্গে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে মো. রতন (৩২) ও আতিক (৩৩) নামের স্থানীয় দুই যুবকসহ চার জন দুটি মোটরসাইকেলে করে ভবেশের বাড়িতে আসেন। এরপর বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী বাজারে যাওয়ার কথা বলে ভবেশকে তাদের মোটরসাইকেলে তুলে নেন। এরপর রাতে তার অসুস্থতার খবর পায় পরিবার।
ভবেশ চন্দ্র বিরল উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। তিনি উপজেলার শহরগ্রাম শহরগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের বাসুদেবপুর গ্রামের মৃত তারকানন্দ রায়ের ছেলে। তার মৃত্যুর বিষয়ে পরিবার থেকে এখনও থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়নি।
রবিবার দুপুরে ভবেশ চন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান চলছে। চারপাশে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর ভিড়। দুটি জায়গায় জটলা করে মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করছেন তারা। এগিয়ে গেলে তারা কথা থামিয়ে নেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ঘটনার দিনের বিষয়ে জানতে চাইলে একে-অপরের দিকে তাকান।
পরে ভবেশ চন্দ্রের জামাতা রঞ্জিত রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার কিছু ছেলে আমার শ্বশুরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। সুদে নেওয়া টাকার বিষয়ে ফুলবাড়ী বাজারে কথা কাটাকাটি হয়। তারপর নাড়াবাড়ি বাজারে নিয়ে মারধর করা হয়। এতে শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে আমার শ্যালককে ফোন দিয়ে অসুস্থতার কথা বলে তারা। এরপর ফুলবাড়ী বাজারে পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। রাতে খবর দিলে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠায় পুলিশ। এ ঘটনায় আমরা আইনি পদক্ষেপ নেবো। অভিযুক্তদের একজন রতন, আরেকজন আতিক। তাদের সঙ্গে আরও পাঁচ-ছয় জন মারধরের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে জানতে পেরেছি আমরা।’
ভবেশ চন্দ্রের ছেলে স্বপন চন্দ্র রায় দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। শহরের কালীতলা এলাকায় থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করেন। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা ৫৭ মিনিটে বাবার ফোন থেকে আমার সঙ্গে কথা বলেন রতন ভাই। তিনি আমাকে বলেন, ‘তোমার বাবা নাড়াবাড়িতে আছে, পান-বিড়ি খেয়েছে। অসুস্থ হয়ে এখন বমি করতেছে।’ সে সময় আমি বলি, তাহলে একটা ভ্যানে তুলে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর আবারও ফোন দিয়ে বলেন, ‘তোমার বাবার অবস্থা খুবই খারাপ বাড়িতে পাঠানো যাবে না, তুমি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাও।’ পরে অ্যাম্বুলেন্সে বাবাকে নিয়ে রাত সোয়া ৯টায় দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করাই। ইসিজি করে বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
ভবেশ চন্দ্রের স্ত্রী শান্তনা রানী জানান, তার স্বামীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া যুবক মো. রতন একই ইউনিয়নের আবদুস সাত্তারের ছেলে এবং অপরজন হলেন বাসুদেবপুর গ্রামের আবদুল কাদেরের ছেলে আখতারুল ইসলাম ওরফে আতিক। তবে অপর দুজনের নাম বলতে পারেননি শান্তনা রানী।
দুপুরে ছেলে স্বপন চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন মা শান্তনা রানী। আর বলছেন, আমাদের কেউ থাকলো না। আমাদের কী হবে। কীভাবে বাঁচবো আমরা।
শান্তনা রানী জানান, তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। অসুস্থ হয়ে কয়েক বছর আগে মেয়েটি মারা যায়। এখন ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে ছিল সংসার। স্বামীকে হারিয়ে অনেকটা পাগলপ্রায় শান্তনা। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী আতিকের কাছ থেকে সুদের ওপরে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছিল আমার স্বামী। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে তিন হাজার ২৫০ টাকা কিস্তি দিতে হতো। টাকা দিতে দেরি হলে আতিক এসে হুমকি দিতো। সব টাকা পরিশোধ করে দিয়েছিল। তবু আতিক দাবি করতেছিল আরও টাকা পাবে। এ নিয়ে বিরোধ। শেষ পর্যন্ত ওই টাকার জন্য স্বামীকে মেরে ফেলেছে আতিক, রতন ও তার সহযোগীরা। ঘটনায় জড়িতদের আমি ফাঁসি চাই।’
ভবেশ চন্দ্রের বৌদি দিল্লী বালা বলেন, ‘আমার দেবরকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আতিক, রতনসহ চার জন। পরে বাজারে নিয়ে মারধর করে লাশ ফেলে রেখে যায়। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
নিহতের ভাগনে দিবাকর রায় বলেন, ‘রতন, আতিক ও মুনকে আমরা চিনি। বাকিদের চিনি না। তারা এলাকার মানুষকে সুদের ওপর টাকা দিয়ে অতিষ্ঠ করে রেখেছে। সুদের টাকা দিতে দেরি হলে যে কাউকে বাড়ি থেকে নিয়ে মারধর করা হয়। আমার মামাকেও বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মারধর করে হত্যা করেছে তারা।’
স্বপন চন্দ্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বাবাকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রতন, আতিকসহ চার জন। পরে মারধর করলে তার মৃত্যু হয়। আমরা এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
এ নিয়ে এতোদিন কেন চুপ ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে স্বপন চন্দ্র বলেন, ‘তখন বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আর তখন নির্যাতনের বিষয়টি আমরা জানতাম না। পরে যে এলাকায় বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই এলাকার লোকজন বলেছেন, তাকে অনেক মারধর করেছেন রতন ও আতিক তার সহযোগীরা। এ ছাড়া আমরা ভয়ের মধ্যে ছিলাম। ভবিষ্যতে আমার ও পরিবারের সমস্যা হতে পারে ভেবে চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু এখন এলাকাবাসী পাশে দাঁড়িয়েছে, সাহস জুড়িয়েছে। ফলে এখন মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’
এদিকে, ঘটনার পর থেকে রতন ও আতিক নামের ওই দুই যুবক গা ঢাকা দেওয়ায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এমনটি তাদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সবুর বলেন, ‘পান-বিড়ি খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে বলে আমাদের প্রথমদিন জানিয়েছিলেন ভবেশের পরিবারের সদস্যরা। ওই দিন রাত সাড়ে ১১টায় পরিবার থেকে আমাদেরকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। পরে বাড়িতে গিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তবে তার শরীরে আঘাতের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শেষে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের দেওয়া হয়। প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। পরিবার থেকে অভিযোগ পেলে অবশ্যই মামলা হবে।’
দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হুসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভবেশের পরিবারের সদস্যরা এখন পর্যন্ত থানায় মামলা করতে আসেননি, এমনকি অভিযোগও দেননি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। পরিবার যদি মামলা করতে চায় তাহলে অবশ্যই মামলা নেবে পুলিশ। ঘটনার তদন্তে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে।’