বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পুনর্বহাল করার দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সাবেক শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষের মাঝে। শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হলে পাল্টা প্রতিরোধসহ আন্দোলনও কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাল্টাপাল্টি আন্দোলন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরীতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পুনর্বহাল করার দাবিতে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি শুরু করার ঘোষণা দেন।
তাদের দাবি, ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দাবি করতে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রাখার ঘোষণা দেন। অথচ বেগম রোকেয়ার নামে রংপুরে আরেকটি সরকারি কলেজ থাকার কারণে পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বার বার দাবি জানানোর পরও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকার এ বিষয়ে কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেয়নি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ। তারা বলেন, স্বৈরাচারের কোন চিহ্ন শহীদ আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে দেওয়া হবে না।
বুধবার সরেজমিনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্রেডিট নেওয়ার জন্য নাম পরিবর্তন করে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শত কোটি টাকা ব্যয়ে যে অবকাঠামোসহ উন্নয়ন হয়েছে শেখ হাসিনার ১৬ বছরেও এক টাকার উন্নয়ন হয়নি। ফলে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে কোনোভাবেই আমরা গ্রহণ করতে পারি না। তার কোনও চিহ্নই এখানে রাখা হবে না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অপর সমন্বয়ক রহমত আলী বলেন, বেগম রোকেয়াকে আমরা অবশ্যই সম্মান করি। তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত। তার নামে রংপুরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে সারা দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যার জন্য ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করে নতুন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দেওয়া নাম আমরা কোনোভাবেই গ্রহণ করবো না।
তিনি আরও বলেন, তাদের নাম পরিবর্তনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর সমর্থন আছে। সে কারণে সাত দিনের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হবে।
এদিকে বেরোবির নারী শিক্ষার্থীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি বৃহৎ অংশ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বহাল রাখার পক্ষে। তারা বলছেন, তার নাম এতদিন পর পরিবর্তন করা হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে নানান জটিলতা দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে তার নাম পরিবর্তন করার জন্য যারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তাদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নেই বলে তারা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, এতদিন পর বেগম রোকেয়ার নাম পরিবর্তন করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। বেগম রোকেয়া রংপুর তথা দেশের গর্ব। তার নাম বাদ দেওয়ার আন্দোলনকে তিনি একেবারেই সমর্থন করেন না।
শিক্ষার্থী আশফিয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের জন্য যারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তাদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নেই। এখানে তো শেখ হাসিনার পরিবারের নাম নেই, বেগম রোকেয়ার মতো মহীয়সী নারীর নাম বাদ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।
অপরদিকে নাম পরিবর্তন করার যেকোনও অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সাবেক শিক্ষার্থীসহ রংপুরের সব স্তরের মানুষ। নাম পরিবর্তন হলে তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বেরোবির সাবেক শিক্ষার্থী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের রংপুর মহানগর আহ্বায়ক যোগেশ ত্রিপুরা বলেন, আমরা কোনোভাবেই এই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নেই। তারা যে কর্মসূচি দেবে তার পরিবর্তে পাল্টা কর্মসূচি দেওয়া হবে।
রংপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ নেতা মনে করেন, নাম পরিবর্তন করা হলে নানান জটিলতা দেখা দেবে। সে কারণে রংপুর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দাবি তার।
একই কথা বলেন রংপুর মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আল মিলন। তিনি বলেন, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হলে শিক্ষার্থীদের নানান জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। ফলে রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নামে আলাদা নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামের সামনের কাতারের সৈনিক রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন আন্দোলনের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন বলেন, কোনোভাবেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা যাবে না। যারা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন তাদের সরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, না হলে কঠোর প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বেরোবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।