রাজশাহী নগরীতে মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় হামলা ও মারধরে নিহত আকরাম আলী (৪৫) নামের বাসচালক এবং জেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ঘটনায় নিহতের ছেলে বাদী হয়ে সাত জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন নগরীর বোয়ালিয়া থানায়।
জানা গেছে, বুধবার (১৬ এপ্রিল) রাতে মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় আকরাম আলী ও তার ছেলে ইমাম হোসেনকে মারধর করা হয়। পরে আহত অবস্থায় তাদের রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পর আকরাম আলী মারা যান। পরের দিন বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল ৫টার দিকে রাজশাহী নগরীর তালাইমারী শহিদ মিনার এলাকায় নিহতের মরদেহ নিয়ে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের সর্বস্তরের ব্যানারে এই মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ফাঁসির দাবি করা হয়।
স্বজনরা জানান, বিকালে নিহতের মরদেহ রামেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপরে তালাইমারী শহিদ মিনারের সামনে সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। এ সময় এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আকরামের স্ত্রী মুক্তি বেগম বলেন, ‘ওরা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমি তাদের বিচার চাই, ওদের ফাঁসি হোক। ওরা যেন পালিয়ে যেতে না পারে। ঘটনার পরে তাদের এখনও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।’
নিহতের মেয়ে রাকিয়া বলেন, ‘আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাবা ও ভাইয়া হামলার শিকার হয়েছে। ওরা বাবাকে মেরে ফেলেছে। আমি বাপকে হারিয়েছি। এটার দুঃখ ভোলার মতো না। আমি চাই তাদের ফাঁসি হোক।’
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় নিহতের ছেলে অনন্ত বাদী হয়ে সাত জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন- তালাইমারী শহীদ মিনার এলাকার কালু মিয়ার ছেলে মো. নান্টু (২৮), মৃত রতন মিয়ার ছেলে মো. বিশাল (২৮), মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে খোকন মিয়া (২৮), মো. শাহীনের ছেলে তাসিন হোসেন (২৫), মো. অমি (২০), মো. নাহিদ (২৫) ও মো. শিশির (২০)।
এ বিষয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’
এদিকে বাবার নিথর দেহ তখনও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মর্গে। বাড়ির চারপাশে শোক আর কান্নার সুর। তবু চোখ মুছে পরীক্ষাকেন্দ্রে হাজির হলো মেয়েটি। তার নাম আলফি আক্তার। তার এসএসসি পরীক্ষা চলছে। আলফিকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বুধবার একদল বখাটের হামলায় নিহত হন তার বাবা আকরাম হোসেন (৪৫)। হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার (১৬ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে। আর ঠিক পরদিন, বৃহস্পতিবার সকালে এসএসসি পরীক্ষা দিতে যায় তার মেয়ে আলফি আক্তার। বাবার মরদেহ দাফনের আগেই পরীক্ষার হলে বসতে হয় আলফিকে। রাজশাহীর অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের ছাত্রী আলফি। তার পরীক্ষাকেন্দ্র রাজশাহীর শিরোইল উচ্চবিদ্যালয়ে। বৃহস্পতিবার ছিল ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা।
অগ্রণী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আলফি খুবই মেধাবী ছাত্রী। তার বাবাকে যেভাবে খুন করা হয়েছে, তা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
আলফির মা মুক্তি বেগম বলেন, ‘সারা রাত মেয়েটা শুধু কেঁদেছে। কোনোভাবেই পরীক্ষা দিতে চাইছিল না। বারবার বলেছে—বাবা নেই, আমার কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না। পরে আত্মীয়স্বজনরা অনেক বুঝিয়ে পরীক্ষার হলে পাঠায়।’
মুক্তি বেগম জানান, তার মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করছিল তালাইমারির বাবর আলী রোড এলাকার বখাটে নান্টু ও তার সহযোগীরা। বুধবার বিকালে রাস্তায় চলার সময় আলফিকে গালাগালি করে ওই যুবকরা।
ঘটনা শুনে আকরাম হোসেন নান্টুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে নান্টু। রাত সাড়ে ৮টার দিকে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তারা এসে প্রথমে আকরামের ছেলে ইমাম হাসান অনন্তকে মারধর করে।
ছেলের চিৎকার শুনে ছুটে গেলে আকরাম হোসেনকেও ঘিরে ধরে হামলাকারীরা। একপর্যায়ে তার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়। মারাত্মক আহত অবস্থায় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক আকরামকে মৃত ঘোষণা করেন।
বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, ‘দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’