গত ৫ আগস্ট দুপুরে সাভারের আশুলিয়ায় সরকার পতনের বিজয় মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন বগুড়ার সারিয়াকান্দির গার্মেন্টস মেকানিক সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান মিলন (৩০)। সেদিনের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। ওই দিনের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজেও তার সন্ধান পায়নি বলে জানিয়েছে পরিবার।
এ অবস্থায় ১৪ মাসের সন্তানসহ স্ত্রী, মা ও পরিবারের সদস্যরা তার ফেরার অপেক্ষায় আছেন। তাকে ফেরতের আশ্বাসে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে মুক্তিপণের নামে অনেক টাকা খুইয়েছেন। তাকে জীবিত অথবা মৃত ফেরত পেতে অথবা সরকারের নিহত-নিখোঁজ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।
মিলন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের জোড়গাছা গ্রামের মৃত সুরুতজ্জামানের ছেলে। ২০২০ সালের প্রখর রোদে মাঠে কাজ করতে গিয়ে তার বাবা হৃদরোগে মারা যান। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন মিলন। ঢাকা ইপিজেডে ফোর ইয়াং ডায়িং পোশাক কারখানায় মেকানিক বিভাগে সুপারভাইজার পদে কর্মরত ছিলেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট দুপুরে আশুলিয়ায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলনও আনন্দ মিছিলে যোগ দেন। তিনি মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের পানি পান করিয়ে সহায়তা করছিলেন বলে বন্ধুরা পরিবারকে জানান। একপর্যায়ে নিখোঁজ হন। পরে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িসহ সব স্থানে খোঁজ করেও সন্ধান মেলেনি।
মিলনের মা মেরিনা বেগম (৬৫) জানান, মিলনের ছবি বুকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছেন। এখনও ছেলের ফেরার অপেক্ষায় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মোবাইল ফোনে ছেলের কণ্ঠে মা ডাক শুনতে চান; কিন্তু ছেলে ফিরে আসে না। জীবিত আছে নাকি মৃত তাও জানা নেই তার।
তিনি বলেন, ‘মনে হয় ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে কিংবা হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে, বা কোনও গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে শেষ বিদায় জানানোর ভাগ্যও হয়নি আমার।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেরিনা বেগম বলেন, ‘৫ আগস্ট জোহরের আজানের সময় ছেলের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। ওই সময় আমি কেমন আছি জানার পর বিজয় মিছিলে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে মিছিল বা কোনও আন্দোলনে যেতে বারণ করেছিলাম। পরে শুনেছি, ওই দিন দুপুরে মিছিলে গিয়েছিল।’
কথা বলতে বলতে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে হু হু শব্দে কেঁদে উঠে মেরিনা বেগম বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর চার বছর পর সংসারের একমাত্র আয়ক্ষম ছেলে মিলনকে হারালাম। এত শোক কীভাবে সহ্য করবো। ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে আমার চোখের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
মিলনের বড় ভাই মিল্টন মিয়া বলেন, ‘মিলনের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে ৬ আগস্ট ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেদিন সকালে আশুলিয়া থানার সামনে ফুটওভার ব্রিজের নিচে কাভার্ডভ্যানে ছয়টি লাশ দেখতে পাই। এর মধ্যে মিলনের লাশ ছিল না। সারাদিন আশুলিয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল, থানা ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ করেছি। সেখানে প্রতারকের খপ্পরে পড়ে বেশ কিছু টাকা খুড়িয়েছি। পরদিন চীনমৈত্রী হাসপাতালসহ আশপাশের হাসপাতালে খুঁজেছি। শেষে নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরেছি।’
মিলনের লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে এমন খবরে গত ১৮ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে যান মিল্টন। সেখানে ১৯টি লাশের মধ্যেও তার ভাইয়ের লাশ পাননি। এরপর আবারও প্রতারকদের খপ্পরে পড়েন। তারা মিলনের লাশ ফেরত দিতে না পারলেও তার কাছ থেকে কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে নিখোঁজের ব্যাপারে আশুলিয়া থানায় জিডি করেন। এরপর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও মিলনকে পাননি।
মিলনের স্ত্রী সবিতা খাতুন (২৪) জানান, সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে ফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তখন মিলন সেখানে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি স্বামীকে আন্দোলনে না যেতে অনুরোধ করেছিলেন। এরপর আর মিলনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়নি। ওই দিন বিকালে জানতে পারেন মিলনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সবিতা খাতুন বলেন, ‘স্বামী নেই এই কথা মনে হলেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ১৪ মাস বয়সী একমাত্র মেয়ে মারজিয়া মারিয়মকে লালন-পালন ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমি স্বামীকে জীবিত বা তার লাশ ফেরত দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
সারিয়াকান্দির ভেলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম শিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আশুলিয়ায় বিজয় মিছিলে গিয়ে নিখোঁজ হন মনিরুজ্জামান মিলন। গত তিন মাসেও তার খোঁজ পায়নি পরিবার। তার সন্ধান পেতে পরিবার দিশেহারা। কিন্তু দায়িত্বশীলদের কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিখোঁজ মনিরুজ্জামান মিলনের পরিবারকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে। মিলনকে নিখোঁজদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হবে।’
