X
বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
২০ আষাঢ় ১৪৩১

কারাগারের ছাদ যেভাবে ছিদ্র করে পালালেন ফাঁসির ৪ আসামি

বগুড়া প্রতিনিধি
২৭ জুন ২০২৪, ০৯:৪০আপডেট : ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৫

বগুড়ার ১৪১ বছরের প্রাচীন জেলা কারাগার চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত। ছাদের নিচে লোহার বিম দেওয়া থাকলেও ভেতরে কোনও রড নেই। এতে ছাদ দুর্বল হয়ে গেছে। এ সুযোগে কনডেম সেলে থাকা চার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি পরিকল্পনা অনুসারে বালতির লোহার হাতল দিয়ে প্রায় এক মাস ধরে ছাদ ছিদ্র করেন। এরপর তারা পুরাতন কাপড় ও বিছানার চাদর পেঁচিয়ে রশির মতো করে সেটা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে যান। যদিও তারা পালানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।

বুধবার (২৬ জুন) বিকালে বগুড়ার পুলিশ সুপার (পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ডিআইজি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, গ্রেফতার আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বগুড়া জেলা কারাগারের পূর্ব-উত্তর কোণে তিনটি কনডেম সেল রয়েছে। সেখানে ১৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিকে রাখা হয়েছে। জাফলং ভবনের কনডেম সেলে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা গ্রামের মৃত আজিজুল হকের ছেলে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর, নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি গ্রামের মৃত ইস্রাফিল খার ছেলে আমির হামজা ওরফে আমির হোসেন, বগুড়া সদরের কুটুরবাড়ি পশ্চিমপাড়ার ইসমাইল শেখ চাঁদ মিয়ার ছেলে ফরিদ শেখ এবং বগুড়ার কাহালু উপজেলার উলট পুর্বপাড়ার বাসিন্দা ও বিএনপি সমর্থিত কাহালু পৌর মেয়র আবদুল মান্নান ওরফে ভাটা মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়াকে রাখা হয়। এরা সেলের ছাদ দুর্বল জেনে ছিদ্র করে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। প্রায় এক মাস আগে সেলের বাথরুমে থাকা বালতির লোহার হাতল খুলে সোজা করে নেন। এরপর পুরাতন কাপড় ও বিছানার চাদর পেঁচিয়ে রশির মতো করে নেন। এসব রশি দেওয়ালে বেঁধে তারা ছাদ পর্যন্ত পৌঁছান। এরপর ওই লোহার হাতল দিয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে ছিদ্র করতে থাকেন।

সম্প্রতি ছিদ্রটি বড় হয়ে সেদিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরে মঙ্গলবার (২৫ জুন) রাত ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে চার কয়েদি একে একে ওই ছিদ্রপথে কনডেম সেলের ছাদে আসেন। এরপর তারা হামাগুড়ি দিয়ে গ্রিলের বেষ্টনী পার হন। পরে ওই কাপড় ও চাদর দিয়ে তৈরি রশি বেয়ে উঁচু প্রাচীর দিয়ে জেল চত্বরে নামেন। পাশে করতোয়া নদী পেরিয়ে নিকটেই চাষি বাজারে গিয়ে সমবেত হন। এ সময় তাদের গায়ে কয়েদির কোনও পোশাক ছিল না। এরপর রাত সাড়ে ৪টার দিকে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে সদর থানা পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমির হোসেন, ফরিদ শেখ ও জাকারিয়া জানান, তারা সকলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি। জেলের কনডেম সেলের ছাদ ছিদ্র করে তারা পালিয়ে এসেছেন। পরে তাদের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অফিসে আনা হয়। বুধবার দুপুরে পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন।

এদিকে জেল থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক শেখ সুজাউর রহমান সুজা ও রাজশাহী ডিআইজি প্রিজন কামাল হোসেন বগুড়ায় আসেন। তবে বিকাল পর্যন্ত জেলের কোনও কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। তবে ডিআইজি প্রিজন কামাল হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি হবে।’

বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) পি এম ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে পুলিশের একজন, র‌্যাবের একজন, ডিআইজি প্রিজন, ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ও গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বা তার প্রতিনিধি থাকবেন।

তিনি আরও বলেন, ‘কমিটিকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন। পরে প্রতিবেদনটি আইজি প্রিজনকে দেওয়া হবে। তার ওপর ভিত্তি করে কারা কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বগুড়া কারাগার ব্রিটিশ আমলে তৈরি। পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ভবনের অনেক স্থান খারাপ। কনডেম সেলের ছাদের যে স্থানে ছিদ্র করা হয়েছে, সেখানে কোনও রড ছিল না। চুন-সুরকি দিয়ে ছাদটি তৈরি। এসব স্থান সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। আর তারা (চার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি) যেদিক দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সেখানে নিরাপত্তাচৌকি স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।’

বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহিনুজ্জামান শাহিন জানান, জেলা কারাগারের জেলার ফরিদুল ইসলাম রুবেল বুধবার বিকালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই চার কয়েদির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘কয়েদিরা কীভাবে পালিয়ে যায় সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে।’

কোর্ট ইন্সপেক্টর মোসাদ্দেক হোসেন জানান, চার কয়েদিকে বগুড়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে আদালতের নির্দেশে তাদের বগুড়া জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, গ্রেফতার কয়েদিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তারা বাথরুমে থাকা বালতির লোহার হাতল সোজা করে সেটি দিয়ে ছাদ ছিদ্র করেন। এরপর কাপড় ও বিছানার চাদর জোড়া দিয়ে রশি বানিয়ে সেটি দেয়ালে আটকানো হয়। পরে তারা ছাদ ছিদ্র করে কনডেম সেল থেকে বেরিয়ে যান।

তিনি আরও বলেন, ‘কয়েদিরা ছাদের যে জায়গাটি ছিদ্র করার জন্য বেছে নিয়েছিল সেটি বাথরুমের মধ্যে এবং বাইরে থেকে দেখা যায় না। কারারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতেই তারা ওই কর্নারের অংশটি বেছে নেয়।’

বুধবার বিকালে সাংবাদিকদের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক শেখ সুজাউর রহমান সুজা বলেন, ‘বগুড়া জেলা কারাগার ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৪১ বছরের প্রাচীন কারাগার চুন-সুরকির গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত। ছাদে রড নেই। কয়েদিরা ছাদ ছিদ্র করে। বিছানার চাদর দিয়ে রশি বানিয়ে দেয়াল বেয়ে পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তাদের গ্রেফতার করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা কীভাবে সকলের নজর এড়িয়ে পালিয়ে গেলো সে ব্যাপারে তদন্ত করা হবে। দেখতে হবে আমাদের দুর্বলতা কোথায় ছিল। জেলা কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।’

আরও পড়ুন:

/কেএইচটি/
সম্পর্কিত
কিশোরগঞ্জে সোহেল হত্যায় ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড
জমি নিয়ে বিরোধে কবিরাজকে হত্যা: চার জনের মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন
কারাগারের ছাদ ফুটো করে পালানো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪ আসামির রিমান্ড মঞ্জুর
সর্বশেষ খবর
কোটা চায়, নাকি চায় না
কোটা চায়, নাকি চায় না
রোহিত-কোহলিদের বরণে মুম্বাই যেন জনসমুদ্র
রোহিত-কোহলিদের বরণে মুম্বাই যেন জনসমুদ্র
সর্বাধিক পঠিত
প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিপাকে পড়া তরুণীকে নিজ দেশে পাঠাতে পতাকা বৈঠক
প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে বিপাকে পড়া তরুণীকে নিজ দেশে পাঠাতে পতাকা বৈঠক
এমপি আনার হত্যা: ৩ আসামির দোষ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন
এমপি আনার হত্যা: ৩ আসামির দোষ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন
কী আলোচনা হলো সচিবদের বৈঠকে?
কী আলোচনা হলো সচিবদের বৈঠকে?
প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে স্পেন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, যা চায় বাংলাদেশ
প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে স্পেন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, যা চায় বাংলাদেশ
খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?
খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?