সিরাজগঞ্জের তাড়াশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও স্ত্রী-মেয়ের হত্যার ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে তাড়াশ পৌরশহর। পাশাপাশি আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যে। ভদ্র ও সাধারণ জীবন যাপন করা ধনী এই পরিবারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে নানান জল্পনা-কল্পনা। পাশাপাশি কয়েকটি ক্লু নিয়ে কাজ করছে পুলিশ।
এদিকে, মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরের পরে মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে। পাশাপাশি এ ঘটনায় নিহত বিকাশের সম্বন্ধী (স্ত্রীর বড় ভাই) বাদী হয়ে তাড়াশ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।
অপরদিকে, শেষ যেদিন থেকে তাদের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না সেদিন শনিবারও (২৭ জানুয়ারি) বিকালে উপজেলার দেশিগ্রাম শিব মন্দিরে মিটিং করে বাড়িতে লোকজন আসছে বলে দ্রুত চলে আসেন বিকাশ সরকার। আর সেদিন রাতেই তাদের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তাড়াশ উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি তপন কুমার গোস্বামী বলেন, ‘সোমবার (২৯ জানুয়ারি) রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে আমাকে মোবাইলে কল করেন বিকাশের ভগ্নিপতি (বোন জামাই) চন্ডী দাস। ফোন দিয়ে বলেন, দুদিন হলো ওদের ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না, আবার তাদের সম্পর্কে কেউ কিছু বলতেও পারছে না। আমার ছেলেরা প্রাইভেটকার নিয়ে তাড়াশে গিয়েছে। তুমি একটু তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখোতো কী হয়েছে। পরে আমি তাড়াশ উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আনন্দ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে যাই।’
ঘটনার বর্ণনায় তিনি আরও বলেন, ‘তখন প্রায় রাত দেড়টা বাজে। বাড়ির তিনতলায় গিয়ে দেখি তারা যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেখানে দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগানো। পরে তার মোবাইলে কল দিলে ভেতরে তার মোবাইলে রিং বাজতে শুনি। তখন আমরা সেখান থেকে থানায় গিয়ে বিষয়টি জানাই। পরে পুলিশ এসে দরজার তালা ভাঙতেই দেখি ভেতরে তিন জনের লাশ পড়ে আছে।’
তপন গোস্বামী বলেন, ‘দরজা খোলার পরে প্রথম রুমেই দেখি বিকাশের গলাকাটা মরদেহ পড়ে আছে। পাশের রুমে গিয়ে দেখি সেখানে নিচে বিকাশের স্ত্রী ও বিছানায় তার মেয়ের মরদেহ পড়ে আছে। তাদের দুজনেরও গলাকাটা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘শনিবার বিকালে আমরা সবাই উপজেলার দেশিগ্রামে গিয়েছিলাম শিব মন্দিরের কমিটি গঠন নিয়ে একটা মিটিংয়ে । হঠাৎ বিকাশ বললো, তার কাছে কিছু লোকজন আসছে, তাকে দ্রুত বাড়িতে যেতে হবে। বলেই ৫টার দিকে চলে আসে। এরপর থেকে তাকে আর দেখাও যায়নি, মোবাইলেও পাওয়া যাচ্ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিকাশ ধনী হলেও সে সাধারণ জীবন যাপন করতো ও ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিল। তার ইউনিটের ৩-৪ হাত পাশেই তার ভাই প্রকাশের ফ্ল্যাটের দরজা। এর মধ্যে তিনটা হত্যাকাণ্ড হয়ে গেলো কিন্তু তারা বুঝলেনই না, এটা নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। এ ছাড়াও এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা তাড়াশ বাজার। তাড়াশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও খুব আতঙ্কে রয়েছেন।’
এ ব্যাপারে উল্লাপাড়া সার্কেলের (উল্লাপাড়া-তাড়াশ) সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত কুমার সূত্রধর বলেন, ‘একটা হত্যাকাণ্ডের পরে পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের অনেক কাজ থাকে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ফুট প্রিন্ট, রক্তের স্যাম্পল, ডিএনএ নমুনা ছাড়াও নানান রকমের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এরপর মরদেহগুলো উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, শনিবার রাতেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। বিকাশের শরীরে যে পোশাক ছিল তাতে মনে হচ্ছে সে বাইরে থেকে বাসায় এসেছিল। এ ঘটনায় নিহত বিকাশের সম্বন্ধী সুকমল সরকার বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার না হলেও আমরা নানান বিষয়ে পর্যালোচনা করে কিছু ক্লু নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি, খুব দ্রুত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে পারবো।’
সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকালে নিহত তিন জনের মরদেহ মর্গে এসে পৌঁছেছে। বুধবার সকালে তাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে দুপুরের দিকে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হবে।’
এদিকে, এর আগে তাড়াশে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি উল্লেখ করে পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এমন ঘটনা তাড়াশকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাড়াশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। বিকাশ খুবই ভালো লোক ছিল। আল্লাহ তাকে অনেক ধনসম্পদ দিয়েছেন। কিন্তু এগুলো ভোগ করার কেউ রইল না। পুরো পরিবারকে মেরে ফেলা হলো।’ তবে কেন এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এ বিষয়ে তার কোনও ধারণা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মূল ঘটনা উদঘাটন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবেন।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিকাশের বড় ভাই তাড়াশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি প্রকাশ সরকারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ পৌর শহরের বারোয়ারী বটতলা এলাকার কালিচরণ সরকারের ছেলে বিকাশ সরকার (৪৫), তার স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার (৪০) ও মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতা সরকার তুষিকে (১৫) গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটে। স্বজনরা দুদিন যাবৎ তাদের খোঁজ না পেয়ে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে তালা ভেঙে ঘরের মেঝেতে ও বিছানায় তাদের গলাকাটা মরদেহ দেখতে পায়। এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা ছাড়াও পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।