X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

বরেন্দ্রভূমিতে আশা জাগাচ্ছে মরুর খেজুর

আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
২৪ আগস্ট ২০২০, ১০:০০আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২০, ১৮:২৯

চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত খেজুর

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্রভূমিতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর চাষ। উৎপাদন, বাজারজাত ও মুনাফাসহ সবদিক দিয়ে এটি আশাব্যঞ্জক। গবেষকদের মতে, আমদানি করা খেজুরের চেয়ে এই ফল সুস্বাদু। দেশে উৎপাদিত খেজুরের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন তারা। তাই বরেন্দ্র এলাকার উঁচু জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে এর বাগান। সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

জানা গেছে, বরেন্দ্রর উষ্ণ আবহাওয়া ও রুক্ষ মাটিতে ধান ও আমের পাশাপাশি অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে মরুর খেজুর। অন্যান্য ফলের চেয়ে এর সংরক্ষণকাল, চাহিদা ও বাজারমূল্য বেশি। তাই বাণিজ্যিকভাবে খেজুর বাগান গড়তে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা।

নাচোলের এই খেজুর বাগানে এবার ধরেছে প্রচুর খেজুর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার ভেরেন্ডি এলাকায় সর্বপ্রথম ২০১৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের বাগান করে সফলতা পান চাষি ওবায়দুল ইসলাম রুবেল। এর মধ্যে গত বছর দুয়েকটি গাছে খেজুর এসেছিল। এবার তার বাগানে খেজুর ধরেছে প্রচুর। এগুলো আকার ও স্বাদে সৌদি খেজুরের মতো হওয়ায় বাজারে চাহিদা ভালো।

সরেজমিনে রুবেলের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, হলদে সবুজ ও লালচে খেজুর সুবাস ছড়াচ্ছে। থোকায় থোকায় দুলছে সুককারি, বারোহি, আম্বার ও মরিয়মসহ নানান জাতের খেজুর।

চাষি রুবেল ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারেন, দেশেই মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর চাষ হচ্ছে। এজন্য বরেন্দ্রভূমিতে এই ফল চাষে আগ্রহী হন তিনি। ২০১৭ সালে সৌদি আরব থেকে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে অর্ধশত জাতের বীজ সংগ্রহ করে বাড়ির পাশেই তিন বিঘা জমিতে খেজুরের বাগান গড়ে তোলেন। সঠিক পরিচর্যা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে এসেছে কাঙ্ক্ষিত ফল। ৬০০ চারা নিয়ে যাত্রা শুরু করা তার বাগানে এখন গাছের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। আর বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেছেন আরও ৭-৮ হাজারের মতো।

চাষি ওবায়দুল ইসলাম রুবেলের এর বাগানের খেজুর।

খেজুর চাষে উদ্বুদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে ধান ও আম ছাড়া অন্য কোনও ফসল তেমন হয় না। যদিও সম্প্রতি পেয়ারা, মাল্টা, ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফলের চাষ বেড়েছে। কিন্তু সবজি চাষ করে এই অঞ্চলের কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পারেন না। উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে অন্যান্য ফল ও সবজি চাষে খরচ অনেক। কিন্তু সেই তুলনায় লাভ অনেক কম। অন্যান্য ফসলের সংরক্ষণকাল অনেক কম। খেজুর চাষের জন্য এখানকার আবহাওয়া উপযোগী এবং সংরক্ষণকাল, চাহিদা ও বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে খেজুর বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সফলতা পেয়েছি।’

রুবেলের বাগানে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টাকা। যদিও বিনিয়োগের বেশিরভাগ টাকাই চারা বিক্রি থেকে ফিরে এসেছে। তিনি মনে করেন, চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে এই খেজুর চাষ করে লাভবান হতে পারেন।

তবে রুবেল আগ্রহী চাষিদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘বাগান করলাম আর পরের বছরই লাভ পেতে শুরু করবো, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। এজন্য কিছুটা সময় লাগবে। দিনে দিনে গাছ যেমন বড় হয়, তেমনই ফল আসার পরিমাণ বাড়ে। একটি খেজুর গাছ থেকে প্রতিবছর ১০০-১৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। একটি খেজুর গাছ বহু বছর ফল দেয়। তাই এটা অনেকটা রয়্যালটি আয়ের মতো।’

রুবেলের বাগানের খেজুর প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২-৩ হাজার টাকায়। আর বীজ থেকে পাওয়া চারা সর্বনিম্ন ২৫০ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং মাতৃগাছের শাখা চারা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তার এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থানীয় অনেকেই গড়ে তুলছেন খেজুর বাগান। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার বাগান থেকে খেজুর গাছের চারা কিনে নেওয়া হচ্ছে।

খেজুর বাগান করার জন্য চারা তৈরি করা হচ্ছে।

রুবেলের কাছ থেকে ২৫০টি চারা সংগ্রহ করে নিজে একটি বাগান গড়ে তোলেন ভেরেন্ডি গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন। তার আশা, ‘বরেন্দ্রর উষ্ণ আবহাওয়ায় খেজুর চাষ ভালো হবে বলেই বাগান করছি। এখন পর্যন্ত যা বুঝতে পারছি, রুবেলের মতো আমিও খেজুর চাষে লাভবান হবো।’

একইরকম আশাবাদী নাচোল উপজেলার সমাসপুর গ্রামের চাষি আফজাল হোসেন। তিনিও রুবেলের কাছ থেকে ২০০ চারা কিনে গড়ে তুলেছেন খেজুর বাগান। এছাড়া জেলার জামতালা, কল্যাণপুর ও গোবরাতলায় চাষ হচ্ছে মরুর খেজুর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারের জার্ম প্লাজম অফিসার জহুরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ব্যাপক। এখানকার চাষিদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এজন্যই আমরা এর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখছি। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি-আবহাওয়া ও জলবায়ু খেজুর চাষের জন্য উপযোগী এবং উৎপাদন খরচ ও রোগবালাই কম। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির প্রাপ্যতা অনেক কম। খেজুর চাষে পানি কম লাগে। বর্তমানে বাগানগুলোতে আমরা ফল দেখতে পাচ্ছি। এছাড়া এখানকার উৎপাদিত খেজুরের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ আমদানিকৃত খেজুরের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং এই ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং চাষিরা চাষ করে লাভবান হবে বলেই আমাদের আশা।’

রুবেলের বাগানের খেজুর

তবে গবেষকদের মন্তব্য, খেজুর বাগান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিশেষ করে চারা কিনে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও মাতৃগাছের শাখা চারা সংগ্রহের বিষয়ে চাষিদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গবেষকরা বলছেন, ‘একটি বাগানে প্রতি ২০টি মাতৃগাছের পাশাপাশি একটি অথবা দুটি পুরুষ গাছ লাগাতে হবে। তাহলে ভালো পরাগায়ন হবে এবং গাছে খেজুর ভালো আসবে। তা না হলে ফলন ভালো হবে না।’

চারটি বীজ থেকে উৎপাদিত চারার তিনটিই পুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে বীজের চারা কিনে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই গবেষকদের পরামর্শ, ‘বাগান করতে চাইলে বীজের চারা এড়িয়ে চলাই ভালো। সেক্ষেত্রে টিস্যু কালচারের চারা অথবা মাতৃগাছের শাখা চারা অর্থাৎ যে গাছে খেজুর ধরেছে, দেখা যাচ্ছে সেই গাছের স্যাকারকে ডিভিশন করে চারা তৈরি করে লাগালে একজন চাষি শতভাগ স্ত্রী গাছ পাবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যদি একজন কৃষক খেজুর চাষ করে বা বাগান গড়ে তোলে তাহলে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ভালো ফল পেতে অবশ্যই স্ত্রী গাছের পাশাপাশি পুরুষ গাছ লাগাতে হবে বাগানে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় উৎপাদিত খেজুর ও বাগান পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করছি আমরা। আগামীতে দেশে খেজুরের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর চাষ সম্প্রসারণের কথা ভাবা হচ্ছে। যেহেতু জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া অনেকটা মধ্যপ্রাচ্যের মতোই। তাই আমাদের আশা, এই অঞ্চলে খেজুর চাষ সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে খেজুর চাষে কৃষকরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।’

/জেএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী নয়, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার চায় এনসিপি: নাহিদ ইসলাম
মাদারীপুরের শিবচর থেকে ককটেল-গুলি ও ইয়াবা উদ্ধার
মাদারীপুরের শিবচর থেকে ককটেল-গুলি ও ইয়াবা উদ্ধার
গৃহকর্মী-যৌনকর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ
গৃহকর্মী-যৌনকর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ
সবার জন্য উন্মুক্ত হবে মাঠ, কোনও ক্লাবের দখলে থাকবে না: ডিএনসিসি প্রশাসক
সবার জন্য উন্মুক্ত হবে মাঠ, কোনও ক্লাবের দখলে থাকবে না: ডিএনসিসি প্রশাসক
সর্বাধিক পঠিত
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে