করোনাকালে একটা ছোট্ট সুখবর দিয়েছে রাঙামাটি। এ জেলায় উৎপাদিত আম এ বছর দেশ ছাড়িয়ে গেছে বিলাতে। গেছে আরেক ইউরোপীয় দেশ ইতালিতে। আমের মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিদেশের আমদানিকারকরাও। রফতানির আদেশ আছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। ছোট চালান কিন্তু সবে শুরু। স্থানীয় আমচাষিদের আশা, ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, মেহেরপুর, সাতক্ষীরার পর রাঙামাটি থেকেও বিপুল পরিমাণ আম বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। এলাকাতেও গড়ে উঠবে আরও বেশি আমবাগান।
তবে আমের এমন চাষবাষ রাঙামাটিতে আগে তেমন ছিল না। আমগাছ বা আমবাগান ছিল না তা বলা যাবে না তবে উৎপাদনে এত সাফল্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। আগেও প্রচুর আম হয়েছে রাঙামাটিতে কিন্তু, পোকা মাকড়ের উপদ্রব, এবং পরিচর্যার অভিজ্ঞতার অভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় চাষিরা আম চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলেন। তবে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কৃষি বিভাগ। সরকারের এই সংস্থাটির নিরলস চেষ্টা ও শ্রমে এখন মানসম্পন্ন আমের চাষ হচ্ছে রাঙামাটির নানিয়ারচরে। দেশের পাহাড়ি এলাকা থেকে আম আগেও বিদেশে গেছে তবে কৃষি বিভাগ বলছে, এখন আমের গুণগত মান বাড়ায় ইউরোপের বাজারে বেড়েছে পাহাড়ের আমের চাহিদা।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নানিয়ারচর উপজেলাজুড়ে শুরু করা হয় বাগান পরিচর্যা। এরমধ্যে বেশি মনোযোগ ছিল নানিয়ারচর আর বগাছড়িতে। যার ফলে আগের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে আমের গুণগত মান বাড়ে। এ আম খেতে সুস্বাদু হওয়ায় পাহাড় এলাকার প্রবাসী বাসিন্দাদের মাধ্যমে নানিয়ারচরে উৎপাদিত হিমসাগর ও আম্রপালি জাতের ৭০০ কেজি আমের একটি চালান ইতোমধ্যে ইতালিতে পৌঁছেছে। রফতানি আদেশ পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। এতে আশায় বুক বাঁধছে আম বাগানিরা।
কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলার বগাছড়ি হতে ২ হাজার ৬০০ কেজি ল্যাংড়া, হিমসাগর ও আম্রপালি জাতের আম ইউরোপের দেশ ইতালিতে এবং ৪০০ কেজি যুক্তরাজ্যে রফতানি করা হয়েছে। আরও ৮ হাজার ৫০০ কেজি আম রফতানির আদেশ পাওয়া গেছে।
জেলায় বর্তমানে ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে।
কৃষি বিভাগ আরও জানায়, স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আম ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করা হলেও রফতানির জন্য নেওয়া আমের দাম চাষিরা পাবেন প্রতি কেজি ১০০ টাকা হিসেবে। গত বছর প্রতি হেক্টর জমিতে আম উৎপাদন হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ মণ করে। আর বিশেষভাবে বাগানে পরিচর্যা করায় সেই একই বাগানে এবার প্রতি হেক্টর জমিতে ২০০ থেকে ২৫০ মণ আম উৎপাদন হয়েছে।
আম বাগানি মো. মানিক মিয়া জানান, আমের ফলন কম হওয়ায় বাগান কেটে ফেলার চিন্তা করেছিলাম। তখন কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী আম বাগান পরিচর্যা করায় এবছর যে গাছে আম ধরতো না সেই গাছেও তিনগুণ আম ধরেছে। চলতি বছরে তাদের কয়েকজনের মালিকানাধীন পাঁচটি আম বাগানে প্রায় ৫ হাজার আম গাছে ফলন এসেছে। যার মধ্যে প্রায় ৬ লাখ আমে ব্যাগিং করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবছর দ্বিগুণ লাভ হবে বলে আশা করছি।
আম বাগান ইজারিদার মো. গোলাম মাওলা বলেন, পাহাড়ের আম বাগানিরা ফলন কম হওয়ায় বাগান কেটে ফেলছে এমন খবর পেয়ে আমরা কয়েকটি বাগান ইজারা নেই। কিভাবে বাগান পরিচর্যা করতে হয় সেই বিষয়ে বাগান মালিকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় এবং এবছর প্রচুর ফলন হয়েছে প্রতিটি বাগানে।
নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি এলাকার আম বাগানি মো. ইসমাইল হোসেন জানান, গত দুই বছর ধরে আমের ফলন ভালো হচ্ছিল না। বাজারের বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে ওষুধ নিলেও পোকার আক্রমণ বন্ধ করা যাচ্ছিল না। পার্শ্ববর্তী বাগানের আম এবার গত বছরের তুলনায় ভালো হয়েছে দেখেছি। আগামীতে আমিও কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী বাগান পরিচর্যা করবো। আশাকরি আগামী বছর ফলন ভালো হবে এবং আমার বাগানের আমও বিদেশে যাবে।
তবে আম বাগান করে হতাশ ইসলামপুর এলাকার চাষি মো. সোহেল মিয়া। তিনি জানান, গত কয়েক বছর বাগানে যা খরচ হয়েছে সেই টাকাও ঠিকমতো ওঠেনি। এবছর করেনার কারণে ব্যাপারিরাও না আসায় দামও ভালো পাইনি। আমের বাগান কেটে সেগুন বাগান করার চিন্তা করছি। তবে কৃষি বিভাগের পরামর্শ পেলে আবার ভাববেন বলে জানান তিনি।
রাঙামাটি নানিয়ারচর হর্টিকালচার সেন্টারের সিনিয়র উদ্যানতত্ত্ববিদ (উপ পরিচালক), কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম জানান, পুরো নানিয়াচর এলাকা আনারসের জন্য বিখ্যাত হলেও অনেক কৃষক আম বাগান করেছে এখানে। কিন্তু, পোকার উপদ্রবের ফলে ফলন ভালো না হওয়া হতাশ বাগানিরা। তবে প্রশিক্ষণ পাওয়ায় আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় বাগানিরা। যাদের পতিত জমি আছেও তারাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন বাগান করতে।
বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, দেশের হাইকমিশন ও দূতাবাস কর্মকর্তাদের কাছে পাহাড়ের আম পাঠানো হয়। তারা আম খেয়ে এর স্বাদ ও ঘ্রাণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এর ধারাবাহিকতায় ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্টেলিয়া থেকে আমের চাহিদা এসেছে।
তিনি আরও জানান, প্রকল্পের আওতায় আম চাষিদের বাগানের নিবিড় পরিচর্যা, সার ও বালাইনাশক প্রয়োগসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার কারণে এলাকার আম বাগানের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী বছর মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই বাগানিদের তালিকা তৈরি করা হবে এবং বাগান পরিচর্যা, সার ও বালাইনাশক প্রয়োগসহ অন্যান্য বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিটি চাষিকে প্রশিক্ষিত করা হবে।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উপ-পরিচালক পবন কুমার চাকমা বলেন, পাহাড়ের মাটি ও জলবায়ু ফল উৎপাদনের উপযোগী। বাগানিদের বাগান পরিচর্যার অভিজ্ঞতা কম থাকায় গুণগত মানের ফল উৎপাদন করতে পারছিল না। কৃষি বিভাগ ঐসব বাগানিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই উপজেলার আমের এই সাফল্য এখন পুরো জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানালেন কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা।