পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, সুন্দরী গাছ। শুধু তা-ই নয়, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও আমাদের রক্ষা করে এই বন। বন রক্ষায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে বিগত কয়েক মাসে বনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। কমে এসেছে সুন্দরী গাছ পাচার। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে নদ-নদী ও রাস্তাঘাট অনেকটা ফাঁকা থাকার সুযোগ নিয়ে অসাধু লোকজন সুন্দরবনের হরিণ শিকার এবং গাছ পাচারে মেতে উঠেছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র হরিণ শিকার করে মাংস ও চামড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করে চলেছে। এই শিকারিদের দমন করা না গেলে বিরল প্রজাতির এই হরিণ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বিরল প্রজাতির এই হরিণ রক্ষায় সুন্দরবনে রেড এলার্ট জারি করে টহল জোরদার করেছে বন বিভাগ।
প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সুন্দরবনকে দুটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। বাগেরহাট জেলার শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ এবং খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ নিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগ। এরমধ্যে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে মাত্র ৩৬ দিনের ব্যবধানে পুলিশ ও বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে শিকারিদের কবল থেকে ২৪টি জীবিত হরিণ, ৭৯ কেজি হরিণের মাংস এবং ছয় হাজার ৬০০ ফুট হরিণ ধরার নাইলন ফাঁদ উদ্ধার করেছে। এ সময় সাত শিকারিকে আটকসহ চারটি ট্রলার ও দুটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।
বন বিভাগ জানায়, ৩০ মার্চ সুন্দরবন বিভাগ এবং পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে বন থেকে শিকার করে নৌকায় লোকালয়ে ফেরার সময় চাঁদপাই রেঞ্জের সুন্দরবন সংলগ্ন চটেরহাট এলাকার নিত্তিখালী খাল থেকে ৩৬ কেজি হরিণের মাংসসহ এক শিকারিকে আটক করে। এ সময় একটি নৌকা জব্দ করা হয়। গত ১৭ এপ্রিল শরণখোলা রেঞ্জের চান্দেশ্বর এলাকায় বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে ৭শ' ফুট, ১০ এপ্রিল কচিখালী এলাকা থেকে ৫শ' ফুট এবং ২৮ মার্চ একই রেঞ্জের চরখালী এলাকা থেকে ৫শ' ফুট হরিণ ধরার নাইলন ফাঁদ জব্দ করা হয়। তবে কোনও শিকারিকে আটক করা যায়নি।
গত ২২ এপ্রিল একই উপজেলার শাপলবাজার ইউনিয়নের বলেশ্বর নদীর পার হয়ে লোকালয়ে আসার সময় সুন্দরবনের প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির বারকিং ডিয়ার (মায়া হরিণ) দুলাল নামের এক জেলে উদ্ধার করেন। পরে বন বিভাগ হরিণটি বনে অবমুক্ত করে। গত ২৩ এপ্রিল দুপুরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শরণখোলা স্টেশন অফিসের বনরক্ষীরা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি সংলগ্ন এলাকা থেকে পাচারের জন্য রাখা ১০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করে। তবে এ সময় কোনও পাচারকারীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২৪ এপ্রিল ভোরে সুন্দরবন সংলগ্ন সোনাখালী গ্রামের বাদল মোল্লার পুকুর পাড় থেকে এলাকাবাসী একটি হরিণ ধরে মঠবাড়িয়া থানায় নিয়ে যান। পুলিশ বন বিভাগকে খবর দিলে তারা মাদি হরিণটি উদ্ধার করে ওই দিন বিকালে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ সংলগ্ন বনে অবমুক্ত করেন। গত ২৭ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারি স্টেশনের বনরক্ষীরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ঢাংমারি থেকে তিন কেজি হরিণের মাংসসহ এক চোরা শিকারিকে আটক করে। গত ২৫ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের বাদামতলা খাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই হাজার ৭০০ ফুট নাইলনের দড়ির হরিণ ধরা ফাঁদ উদ্ধার করে বন বিভাগ। তবে এ সময় কোনও শিকারিকে আটক করা যায়নি।
গত ২ মে শরণখোলা রেঞ্জের ডিমেরচর থেকে দুপুরে হরিণ শিকারের প্রস্তুতিকালে দুই শিকারিকে আটক করে বন বিভাগ। এ সময় হরিণ শিকারের জন্য বনের ভেতর পেতে রাখা ১৫শ' ফুট নাইলনের দড়ির ফাঁদ ও একটি ট্রলার উদ্ধার করা হয়।
গত ৫ মে সুন্দরবনের পাথরঘাটার চরদোয়ানী এলাকার শীর্ষ তালিকাভুক্ত চোরা শিকারি মালেক গোমস্তা তার দল নিয়ে অবৈধ পথে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের শেলারচর-কোকিলমনি এলাকায় ঢুকেছে বলে গোপনে সংবাদ পায় বন বিভাগ। পরে সেখানে অভিযান চালিয়ে টিয়ারচর থেকে হরিণ শিকারকালে তিন জনকে আটক করা হয়। এ সময় বনের ভেতরে পেতে রাখা ফাঁদে আটকে থাকা জীবিত ২২টি চিত্রা হরিণ উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ৭০০ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ, তিনটি ট্রলার ও একটি নৌকা। পরে হরিণগুলো সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়। শিকারি মালেক গোমস্তা বন বিভাগের হাতে আটক হয়ে এক মাস আগে কারাগার থেকে ছাড়া পায়।
সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মৎস্যজীবীসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা জানান, চোরা শিকারির সংঘবদ্ধচক্র গভীর অরণ্যে হরিণের আবাসস্থল এলাকায় অবস্থান নেয়। কখনও ট্রলারে, কখনও নৌকায়, আবার কখনও বনের গাছে মাচা বেঁধে হরিণের গতিবিধি লক্ষ করে শিকারিরা। তারা রাতে, বিশেষ করে কৃষ্ণপক্ষের রাতে জঙ্গলে বেশি হানা দেয়। সুন্দরবনে যে অঞ্চলে কেওড়া গাছ বেশি জন্মে, হরিণের আনাগোনা সেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে। ভোরে অথবা পড়ন্ত বিকালে হরিণ চরাঞ্চলে ঘাস খায়। শিকারিরা হরিণের এই স্বভাব বুঝে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয় এবং জীবন বাজি রেখে রাতের আঁধারে গহিন অরণ্যে নামে। সুযোগ বুঝে তারা গুলি করে কিংবা ফাঁদ পেতে শিকার করে। হরিণ শিকারের পর গোপন আস্তানায় বসে মাংস প্রস্তুত করা হয়। পরে তা বিক্রি করা হয় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে। এক কেজি হরিণের মাংস ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, দাকোপ, রায়েন্দা, তাফালবাড়ীয়া, পাথরঘাটা, মঠবাড়ীয়াসহ বনের আশপাশের এলাকায় হরিণের মাংস বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া শিকারিরা জাল দেওয়া বা বরফ দেওয়া মাংস, জীবিত হরিণ ও হরিণের চামড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করে থাকে। আবার অনেকে ড্রইংরুমের শোভাবর্ধন করেন হরিণের চামড়া দিয়ে। চোরাই পথে হরিণ শিকার এবং মাংস, চামড়া ও জীবন্ত হরিণ পাচারের নেপথ্যে যেসব রাঘব বোয়াল জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে বিরল প্রজাতির এই হরিণ হারিয়ে যাবে।
করোনার মধ্যে গাছ কাটা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী বলেন, 'লকডাউনের কারণে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীরা বনে যেতে পারছেন না। এই সুযোগে একশ্রেণির অসাধু লোক হরিণ শিকার ও গাছ পাচারের মতো কাজগুলো করছে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর বাগেরহাট জেলা সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ বলেন, ‘সুন্দরবনে হঠাৎ করে হরিণ নিধন এবং পাচার বেড়ে যাওয়া প্রমাণ করে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা নেই। আর বন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরাও ব্যর্থ হচ্ছে বনের সম্পদ রক্ষায়।’
এ প্রসঙ্গে খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. মঈন উদ্দিন খাঁন বলেন, ‘সুন্দরবনে অপরাধীরা অপরাধ করবেই। তবে তাদের জন্য আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। যে কারণে চোরাই শিকারিদের হাত থেকে সম্প্রতি হরিণ, হরিণ শিকারের ফাঁদ ও হরিণের মাংস উদ্ধার করা গেছে। আমরা এসব অপরাধীকে ঠেকাতে নতুন কৌশল অবলম্বন করছি।