X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

সুন্দরবনে আবারও দস্যু আতঙ্কে জেলে-বনজীবীরা

আবুল হাসান, মোংলা
১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০১আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০১

সুন্দরবনে দীর্ঘদিন পর আবারও দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। ইতিমধ্যে বনজীবীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করে দস্যুদের বাহিনী গড়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বনজীবী ও জেলেরা। বনের বিভিন্ন এলাকায় তাদের ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন তারা।

বনজীবী ও জেলেরা বলছেন, দস্যুদের বিভিন্ন বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর দস্যু আতঙ্ক কেটে গিয়েছিল। জেলেরা স্বস্তি নিয়ে মাছ শিকার করেছিলেন। বনের ওপরে নির্ভরশীল মানুষের জীবনেও স্বস্তি এসেছিল। কিন্তু আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দস্যুরা। এতে জেলে ও বনজীবীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। 

সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা বনজীবী ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃতি পশ্চিম সুন্দরবনে আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী নামে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেল ভেঙে পালিয়ে আসা কয়েদি ও চিহ্নিত আসামিরাও সুন্দরবনে দস্যুতা শুরু করেছে। তারা সুন্দরবনে মৎস্য আহরণে যাওয়া জেলেদের কাছ থেকে মাছ, টাকা, মোবাইলসহ সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি বনে ঢুকলে জেলেদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদাও দাবি করছে। নৌকায় করে এসব বনদস্যু সুন্দরবনের গহীনে অবস্থান করে। বনের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে এদের আস্তানা। সুযোগ বুঝে কখনও মাছ ধরার ট্রলার, জেলে কিংবা বনজীবীদের জিম্মি করে তারা। অপহরণের পর দস্যুরা তাদের আস্তানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরিবারের কাছে চাওয়া হয় মুক্তিপণ। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

বনজীবী ও জেলেরা জানিয়েছেন, গত তিন মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ২০ জনের বেশি জেলে ও মৌয়াল অপহরণের শিকার হন। তাদের কাছে দাবি করা হয়েছে ১০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন অপহৃতকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। 

কোস্টগার্ড, বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে গত তিন মাসে অপহরণের ঘটনাগুলো জানান দিচ্ছে আবারও বনে দস্যু বাহিনীর উত্থান ঘটেছে।  

গত ৮ নভেম্বর সুন্দরবনের মালঞ্চ নদের সাতনলা দুনে এলাকায় মাছ ধরার সময় অস্ত্রধারী বনদস্যু বাহিনীর হাতে জিম্মি হন কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের আতাহার হোসেন (৩৫) ও রফিকুল ইসলাম (৩৮)। ওই জেলেদের বহরে চারটি নৌকায় আট জন জেলে ছিলেন। মুক্তিপণের দাবিতে দুই জেলেকে আটকে রেখে অন্যদের ছেড়ে দেয় দস্যুরা।

এই বাহিনীর অনেকে আগে মজনু বাহিনীর সদস্য ছিল। আতাহার ও রবিউল জানান, সুন্দরবনের সাতনলার দুন এলাকায় মাছ শিকারের সময় দয়াল বাহিনী পরিচয়ে দস্যুদের একটি দল তাদের জিম্মি করে। দুই জেলেকে উঠিয়ে নিয়ে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন জেলেরা।

সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা রামপাল উপজেলার চেয়ারম্যান মোড়ের এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুন্দরবনে এখন যে কয়েকটি দস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে, তার মধ্যে দয়াল বাহিনী দুর্ধর্ষ। বাহিনীর সদস্যরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মাছ ধরার ট্রলারে হামলা করে জেলেদের অপহরণ করে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। পরে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। মুক্তিপণের টাকা না দিলে নির্মম নির্যাতন চালায়। কাউকে কাউকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না তারা।’   

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি গ্রামের আবদুল্লাহ তরফদার (৪২) নারী পাচার মামলায় কারাগারে ছিল। ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙচুর করা হলে সেখান থেকে পালিয়ে যায় আবদুল্লাহ। পরে সুন্দরবনে প্রবেশ করে বনদস্যুতায় নামে। আবদুল্লাহর সঙ্গে যারা রয়েছে, তাদের অধিকাংশ কারাগার থেকে পালিয়েছে বলে জানা গেছে।

সবশেষ গত ১০ এপ্রিল সুন্দরবনের গহীন থেকে বনদস্যু করিম শরীফ বাহিনীর হাত থেকে ছয় নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। তবে এ সময় কোনও দস্যুকে আটক করা যায়নি। তবে এর আগে অস্ত্রসহ কয়েকজন দস্যুকে আটক করেছিল কোস্টগার্ড।

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বগেরহাট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দস্যুরা সাধারণত বনজীবী কিংবা জেলেদের ছদ্মবেশে সুন্দরবনে প্রবেশ করে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ে। এসব দস্যুর ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করা হবে, যাতে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে এবং দস্যুদের পরিবারের ওপরও নজর রাখতে হবে। সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়াতে হবে। সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটি শুধু একটি নিরাপত্তা ইস্যু নয়, বরং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের ইঙ্গিতও। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ও এর ওপর নির্ভরশীল মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’ 

এ বিষয়ে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সদর দফতরের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিগত দিনে সুন্দরবনের দস্যুতা দমনে কোস্টগার্ড যেমন তৎপর ছিল, বর্তমানেও তেমন তৎপর রয়েছে। আমরা অপহরণের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছি।’ 

/এএম/
সম্পর্কিত
সুন্দরবনের দস্যু করিম শরিফ বাহিনীর দুই সহযোগী অস্ত্রসহ আটক
খাগড়াছড়িতে অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীসহ ছয় জনকে উদ্ধারে অভিযান চলছে
সন্তান বিক্রি করে জুয়েলারি ও মোবাইল কিনেছেন মা
সর্বশেষ খবর
দেশের ইতিহাসে ‘শ্রেষ্ঠ নির্বাচন’ হবে, আনফ্রেলকে আশ্বাস প্রধান উপদেষ্টার
দেশের ইতিহাসে ‘শ্রেষ্ঠ নির্বাচন’ হবে, আনফ্রেলকে আশ্বাস প্রধান উপদেষ্টার
নারী নির্যাতনের মামলায় থানায় বৃদ্ধ, খোঁজ-খবর নিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
নারী নির্যাতনের মামলায় থানায় বৃদ্ধ, খোঁজ-খবর নিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
আফগানিস্তান-তাজিকিস্তান সীমান্তে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প
আফগানিস্তান-তাজিকিস্তান সীমান্তে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প
চীন সরকারের উপহারের হাসপাতাল নীলফামারীতে স্থাপনের দাবিতে মানববন্ধন
চীন সরকারের উপহারের হাসপাতাল নীলফামারীতে স্থাপনের দাবিতে মানববন্ধন
সর্বাধিক পঠিত
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে
চীনের অর্থনীতি আবারও চমকে দিলো বিশ্বকে