পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে নতুন উদ্দীপনায় পথচলার বার্তা নিয়ে শুরু হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। আর নতুন বছর বরণ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য যশোরে নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ‘যতনে রাখি এ ধরিত্রীরে’ স্লোগানে বাংলা নববর্ষ বরণ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কর্মীরা।
গত কয়েকদিন দিনরাত পরিশ্রম করেছেন শোভাযাত্রার মধ্যে চলমান থিয়েটার উপস্থাপনে। চলতে চলতে থিয়েটার করা যাবে, যার উদ্বোধন করবেন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ জনক ভাস্কর মাহবুব জামাল শামীম। তার মতে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সম্মিলিতভাবে শত কোটি হাতে পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে করোনা মহামারির পর তারা যুদ্ধে নেমে গেছে। এবার শোভাযাত্রা হবে অন্যরকম, একঘেয়ে নয়। প্রকৃতির প্রধান অনুষঙ্গ বৃক্ষ, থাকবে শিশুদের সঙ্গে। তাদের হাতে থাকবে টিয়াসহ নানা পাখি। গাছের দলে থাকবে বড় একটি গাছ। এর ভেতরে বাঘ-হরিণ, যারা টম ও জেরির মতো খেলবে। থাকবে হাতি, বানর- অদ্ভূত একটা ডিসপ্লে, যা একটি নাট্যগোষ্ঠী দায়িত্ব নিয়েছে। আবার থাকবে পাহাড়, যেখান থেকে নদী নেমে আসছে, নদীর মুখে থাকবে দুটো কুমির। এগুলো দৃশ্যমান হবে। পাশাপাশি থাকছে মাছের দল। আমাদের মাতৃভূমি কিন্তু বাঘ-কুমিরের দেশ। শোভাযাত্রায় এই ডিসপ্লের দায়িত্ব নিয়েছে আরেকটি নাচের দল।
এই উৎসবে শুধু তারা একা নন, যশোরের সব সাংস্কৃতিক ও চারুকলার সংগঠন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বর্ষবরণে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে সব শ্রেণিপেশার মানুষের মিলনমেলায় রূপান্তরিত করতে তারা কাজ করে চলেছেন। আর সমগ্র আয়োজনে নিরাপত্তা দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নববর্ষ বরণে নানা আয়োজন রেখেছে। চারুপীঠ, বিবর্তন যশোর, উদীচী, পুনশ্চসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে চলছে শোভাযাত্রার জন্য পুতুল, পাখি, মুখোশ, পাপেট, ফেস্টুন তৈরির কাজ। চলছে গান, নাচ, নাটক ও গীতিনাট্যের মহড়া।
চারুপীঠ যশোরের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ শুরু সোমবার। যতনে রাখি এ ধরণীরে প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি আমরা। আশা করছি, এবারের শোভাযাত্রা আরও সুন্দর ও বর্ণাঢ্য হবে। সব শ্রেণিপেশার মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন।’
পুনশ্চ যশোরের সাধারণ সম্পাদক পান্না লাল দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবারও বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের আয়োজনের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সোমবার বিকাল ৫টায় টাউন হল ময়দানে বর্ষবিদায় ও পরদিন সকাল সাড়ে ৬টায় মুললিম একাডেমি মাঠে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। অনুষ্ঠান সফল করতে নাচ, গান ও নাটকের অনুশীলন অব্যাহত আছে।’
উদীচী যশোরের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলা নতুন বছর বরণে প্রস্তুতি শেষ। বরাবরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখ ভোর ৬টা ৩১ মিনিটে যশোর পৌর পার্কে সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকবে। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে অনুষ্ঠান চলবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ডিএল রায়সহ পঞ্চকবির গান এবং সমসাময়িক বিষয়ে উদীচীর নিজস্ব গণসংগীত পরিবেশন হবে। এরপর আবার বিকাল ৪টায থেকে একই মঞ্চে সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদীচী যশোর ৪৯তম বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করবে।’
বিবর্তন যশোরের সভাপতি নওরোজ আলম খান চপল বলেন, ‘বর্ষবরণ ঘিরে বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ। বিবর্তন যশোর ও সুরধুনী যৌথভাবে নব কিশলয় স্কুলে সকালে ও বিকালে যথাক্রমে ছোট ও বড়দের দুই বিভাগে আবৃত্তি, গান ও নাটক মঞ্চস্থের আয়োজন করা হয়েছে। সকালের অনুষ্ঠান শেষ করে জেলা প্রশাসন আয়োজিত বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের পর সংগঠন প্রাঙ্গণে মিষ্টিমুখের আয়োজন থাকবে।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যশোরের ৩০টির অধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নববর্ষকে বরণ করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। নাচ, গান, নাটক ও আবৃত্তির মহড়া চলছে। আশা করছি, বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে যশোরে সাজসাজ রব পড়বে।’
বর্ষবরণ উপলক্ষে জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) নূর-ই- আলম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের আগের দিন থেকেই শহরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পোশাক ও সাদা পোশাকে পুলিশ থাকবে শহরের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানস্থলে। সকালে মূল অনুষ্ঠানস্থল শহরের পৌর পার্কে মেটাল ডিটেক্টরসহ বিভিন্ন স্থানে উঁচু ভবনের ছাদে অবজারভেশন পোস্ট, শোভাযাত্রা রুটে যানজট এড়াতে শহরের ২২টি পয়েন্টে ট্রাফিক ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। এ ছাড়া মোবাইল টিম ও গোয়েন্দা তৎপরতা থাকবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
এবারের নববর্ষ আনন্দমুখর পরিবেশে সবার অংশগ্রহণে উদযাপিত হবে বলে জানিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা যশোরের সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক সভা করেছি। বৈশাখের দিন সকাল ৯টায় জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ, এসো এসো... গানের মাধ্যমে যশোর কালেক্টরেট চত্বর থেকে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা শুরু হবে। এরপর যশোরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের নিজ নিজ ভেন্যুতে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। এবার আগের মতো নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। যেহেতু এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে সে কারণে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো তাদের অনুষ্ঠানের সময়সূচি যেন এমনভাবে সাজায়, যাতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা না হয়। আমরা আনন্দও করবো, আবার শিক্ষার্থীরাও যেন অসুবিধায় না পড়ে।