সুন্দরবনের দুবলার শুঁটকিপল্লিতে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। এখন মাছের ভরা মৌসুম। শুঁটকিপল্লি নানা প্রজাতির মাছে পরিপূর্ণ থাকার কথা। কিন্তু সাগরে জাল ফেলে প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। মাছ শুকানোর বেশিরভাগ ভারা (মাচা) ও চাতাল খালি পড়ে আছে। শুঁটকি উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হতে পারে বলে মনে করছে বন বিভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
বন কর্মকর্তারা জানান, ধীরে ধীরে সাগরের গভীরতা কমছে। পরিবর্তিত হচ্ছে পানির গতিপথ। যে কারণে মাছের আধিক্য কম হতে পারে। অন্যদিকে সাগরে ঘন ঘন সৃষ্টি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে সাগর উত্তাল থাকায় ঠিকমতো জাল ফেলতে পারছেন না জেলেরা। মাছ কম হওয়ার এটিও একটি কারণ।
দুবলা শুঁটকিপল্লির ব্যবসায়ী নাদিমুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয় দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুম। শুরু থেকেই নিম্নচাপ, ঝড়-বৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ লেগেই আছে। মাছের আধিক্যও কম। লইট্যা, ছুরি, রূপচাঁদা, লাক্ষা মাছ তেমন ধরা পড়ছে না জালে। বেশিরভাগই কম মূল্যের ছোট চিংড়ি, চ্যালা ও পারসে জাতীয় মাছ মিলছে, যার কেজি ২০০-৩০০ টাকা। আর আকারভেদে এক কেজি লইট্যা ৬০০-৮০০ টাকায়, ছুরি ৭০০-১৭০০ টাকায়, রূপচাঁদা ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় এবং লাক্ষা ৪৫০০-৫০০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু এসব মূল্যবান মাছ খুবই কম পাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।’
বৃহত্তম শুঁটকিপল্লি আলোরকোলের জেলে আব্দুর রাজ্জাক সরদার জানান, গত ২০-২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবহাওয়া খারাপ থাকায় সাগরে কোনও জেলে নামতে পারেনি। একই শুঁটকিপল্লির ব্যবসায়ী সুলতান মাহমুদ পিন্টু জানান, এ বছর শুঁটকি ব্যবসায় একেকজন ব্যবসায়ী দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
শুঁটকি ব্যবসায়ী হক বিশ্বাস বলেন, ‘মৌসুমের ৫ মাসে একজন জেলের বেতন ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। মাছ আহরণ বা শুঁটকি উৎপাদন না হলেও তাদের বেতন ঠিকই দিতে হবে। দুর্যোগে প্রায় এক সপ্তাহ জেলেরা সাগরে যেতে পারেনি।’ আরেক ব্যবসায়ী আমানত আলী বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি সামনেও যদি এভাবে মাছের সংকট থাকে, তাহলে লাভ দূরের কথা, চালান টেকানো দায় হয়ে পড়বে।’
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার আলোরকোল টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান জানান, দুবলা বিশেষ টহল ফাঁড়ির অধীনে আলোরকোল, মাঝের কিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালার চরসহ আশপাশের চরগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে সামুদ্রিক শুঁটকিপল্লি। এর মধ্যে আলোরকোল সবচেয়ে বৃহত্তম শুঁটকি উৎপাদনকেন্দ্র। মাছ ধরতে না পারায় গত সপ্তাহে শুধু আলোরকোলেই ১৬-১৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এ ছাড়া মাঝের কিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, শ্যালার চরসহ ছোট শুঁটকিপল্লিতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার লোকসানে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরও জানান, মাছ সংকটের কারণে শুঁটকি উৎপাদন না হওয়ায় এক সপ্তাহে এক থেকে সোয়া কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ফিনজালের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় ৩ দিন বন্ধ ছিল মাছ আহরণ। তখন রাজস্ব ঘাটতি হয় ৩০ লাখ টাকা।
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ বছর দুবলার চরে শুঁটকি নেই। জেলেরা সাগরে মাছ পাচ্ছে না। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে। আগে শীতে ১-২ টা দুর্যোগ হতো। এখন প্রতি মৌসুমে দুর্যোগ হয়। নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, মেঘ-বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। শৈত্যপ্রবাহের ঘন কুয়াশাও আছে এবার। সব মিলিয়ে প্রকৃতি এবার জেলেদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করছে।’
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরল করীম বলেন, ‘মাছ না পাওয়ায় জেলে-মহাজনদের লোকসানের পাশাপাশি সরকারি রাজস্ব আয়েও ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। গত বছর শুঁটকি খাত থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিল সাত কোটি ২৩ লাখ টাকা। এবার ৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম।’