কৃষিপণ্য পরিবহনে স্পেশাল ট্রেনটি প্রথম দিনের মতো আজও সবজি ছাড়াই যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। পণ্য পরিবহনে কম খরচ, নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত পরিবেশে ঢাকায় সবজি পাঠানোর সহজ পদ্ধতি হলেও চাষিরা এই বিশেষ ট্রেন ব্যবহার করছেন না।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তিন কারণে তারা সবজি পরিবহনে ট্রেন ব্যবহার করছেন না। সেগুলো হলো- এ বছর জুলাইয়ের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝপর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাতে সবজি উৎপাদন কম, যশোরের যেসব ক্ষেতে সবজি রয়েছে কৃষকরা সেখান থেকেই বিক্রি করে দিচ্ছেন এবং সবজি ক্ষেত থেকে স্টেশন পর্যন্ত আনতে মাধ্যম (ভ্যান, নসিমন, করিমন ইত্যাদির ভাড়া, লেবার কস্ট ইত্যাদি) খরচের কারণে আগ্রহ হারিয়েছেন। অবশ্য, সবজির উৎপাদন বাড়লে কৃষকরা ট্রেন ব্যবহার করবেন বলে আশা প্রকাশ রেল কর্মকর্তার।
নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখীর কারণে নাকাল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের ১৫টি উৎপাদক অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে দেশব্যাপী সরবরাহ নিশ্চিতের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ।
তারই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে খুলনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’। সেই দিন কৃষিপণ্য বা খাদ্যসামগ্রী বুকিং ছাড়াই যশোর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যায় ট্রেনটি।
সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে আজও (২৯ অক্টোবর)। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ যশোর রেলওয়ে স্টেশনে থামে বিশেষ এই ট্রেনটি। মিনিট দশেক বিরতির পর ফের ঢাকা অভিমুখে চলে যায় সবজি বা খাদ্যপণ্য বুকিং ছাড়াই।
বিশেষ এই ট্রেনের পরিচালক শেখ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ঠিক সময়েই আমরা খুলনা থেকে রওনা দিয়েছি। সেখান থেকে কোনও সবজি ওঠেনি। যশোর স্টেশন ত্যাগ করছি একইভাবে। কেন ট্রেনে কৃষকরা সবজি পাঠাচ্ছেন না, সে বিষয়ে আমি বলতে পারবো না।’
এদিকে, সবজিচাষি ও সবজির ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যশোর থেকে ট্রেনে সবজি পাঠানো হচ্ছে, বিষয়টি তারা প্রথম দিকে জানতেন না।
ব্যাপারী আতিয়ার রহমানের মতে, আড়ত থেকে সবজি পাঠানোর জন্যে তাদের কাছে ট্রাকই সুবিধাজনক। কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য আড়তে দিয়ে যান। আর ট্রাক একদম আড়তের সামনে দাঁড়িয়ে লোড দিতে পারে। এতে কৃষক ও ব্যাপারী দুই পক্ষের সুবিধা। আর স্টেশনে যাওয়া কষ্টকর, সেখানে মাল ওঠানো-নামানো ঝামেলার।
বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে, অথচ যশোর থেকে সবজি পাঠাচ্ছেন না কৃষক, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদফতরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা (ইনচার্জ) সালাম তরফদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে দুই-চার মণ সবজি ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করা অসম্ভব ব্যাপার। এখন বিভিন্ন সবজি উৎপাদন এলাকার নানা জায়গায় কালেকশন পয়েন্ট রয়েছে। সেখানে বিক্রি করাই তাদের জন্যে সুবিধাজনক।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ ট্রেনের হ্যাসেল সম্পর্কে অবহিত। স্টেশনে কুলিদের দৌরাত্ম্য, মালামাল নিয়ে টানাটানি তাদের মনে গেঁথে আছে। এখন যদিও অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সবজি ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আলাপ করেছি। তারা বলেছেন, মাঠ থেকে সবজি আড়তে, সেখান থেকে স্টেশনে এরপর ঢাকায় সব মিলিয়ে লেবার কস্ট অনেক পড়ে যায়। তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের মার্কেট প্লেস হচ্ছে কারওয়ান বাজার, কিন্তু সেখানে কোনও স্টপেজ নেই। ঢাকার বিমানবন্দর, তেজগাঁ ও কমলাপুর স্টেশনে থামবে। আবার সেখান থেকে মালবোঝাই করে নিয়ে যাওয়া একটা হ্যাসেল। এসব ব্রেক জার্নির কারণে তারা ট্রেনে সবজি পরিবহনে তেমন ইন্টারেস্টেড নয়।’
যশোর রেলওয়ে জংশনের স্টেশনমাস্টার আয়নাল হাসান বলেন, ‘যশোর অঞ্চল থেকে সবজি ঢাকায় দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্যে সপ্তাহের একদিন প্রতি মঙ্গলবার এই বিশেষ ট্রেনটি চালু করা হয়েছে। কিন্তু আমরা আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছি না। কৃষকদের আগ্রহ বেশ কম। কৃষি বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাতে সবজি পরিবহনে তারা সচেষ্ট হয়।’
তিনি বলেন, ‘ট্রেনে পরিবহন করা হলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজি, হয়রানিমুক্ত পরিবেশ পাবেন। শুধু স্টেশনে এসে মাল ট্রেনে উঠিয়ে দেবেন এবং গন্তব্যে নামিয়ে নেবেন। কোনও মিসইউজ হবে না। ট্রেনে একটা এসি কম্পার্টমেন্ট রয়েছে, সেখানে পচনশীল দ্রব্য (যেগুলো ফ্রিজিং করা লাগে) পরিবহন করতে পারবেন।’
সাম্প্রতিক অতি বৃষ্টিতে ফসলহানিকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ‘উৎপাদন কম বলে কৃষক এখন পাঠাচ্ছে না।’ সবজির উৎপাদন বাড়লে ট্রেনে সবজি পরিবহনের বিষয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রসঙ্গত, সবজির স্পেশাল এই ট্রেনটি ৭ বগির। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি যশোর ছাড়াও মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্টেশন, ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন, বারবাজার, মোবারকগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, সফদারপুর, আনসারবাড়িয়া, উথলি, দর্শনা প্রভৃতি স্টেশনে থামবে। রাতে ট্রেনটি ঢাকার বিমানবন্দর, তেজগাঁ ও কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাবে।
ট্রেনটি মঙ্গলবার খুলনা, বৃহস্পতিবার পঞ্চগড় ও শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় কৃষিপণ্য নিয়ে যাতায়াত করবে। এই ট্রেনে প্রতিকেজি সবজি ও কৃষিপণ্য বহনে ১ টাকা ০৮ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৪৭ পয়সা খরচ পড়বে। এই ট্রেনের মাধ্যমে প্রতিদিন ১২০ টন পণ্য পরিবহনের সুবিধা মিলবে।