গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় উড়াল সেতুর নিচের সড়ক ও ফুটপাত সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের আওতাধীন। চার লেনের এই সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে মাওনা চৌরাস্তা অস্থায়ী বাজার। সড়কের পাশের ফুটপাতও দখল করে নেন হকাররা। সড়কের পাশে যতটুকু খালি জায়গা আছে, সেখানে বসে অস্থায়ী দোকানপাট। এতে দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে হচ্ছে ক্রেতা, ব্যবসায়ী ও পথচারীদের।
এ সমস্যা সমাধানে নেই কোনও উদ্যোগ। উল্টো এই সড়ক ও ফুটপাত ইজারা দিয়েছে শ্রীপুর পৌরসভা। সেইসঙ্গে প্রতি দোকান থেকে খাজনা ২০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ২০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা চাঁদা তুলছিলেন ইজারাদার। এ নিয়ে নিয়ে ইজারাদারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে হকারদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) সকালে চৌরাস্তা বাজারের ইজারাদার কাজল ফকির বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০ জনকে আসামি করা হয়। শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শামীম আখতার বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- শ্রীপুর উপজেলার কপাটিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন শ্রীপুর পৌর শাখার সভাপতি কামাল হোসেন (৪৩) এবং ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার পস্তাইল গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে মাওনা চৌরাস্তার ফল ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান (১৮)। তাদের শুক্রবার রাতে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাজীপুর আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার সন্ধ্যায় মাওনা চৌরাস্তায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে হকার ও ইজারাদারের প্রতিনিধিসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ইজারাদারের প্রতিনিধি নজরুল ব্যাপারী (৬০), তেলিহাটী ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সভাপতি আতিক বন্দোকশী (৪৬) ও ইমরানকে (২৫) ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারা ইজারাদার কাজল ফকির ও সেলিমের পক্ষের লোকজন বলে দাবি করেন। আহত অন্যরা স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
হকার ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাওনা চৌরাস্তায় উড়াল সেতুর নিচের সড়ক ও ফুটপাত সওজের হলেও গত কয়েক বছর ধরে ইজারা দিয়ে আসছে শ্রীপুর পৌরসভা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে খাজনা টাকা তোলা হয়নি। এ সুযোগে রাজনৈতিক নেতারা চাঁদা তুলেছেন। হকাররা কমবেশি চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করে আসছিলেন। গত পহেলা বৈশাখ থেকে অস্থায়ী বাজারের ইজারা নেন শ্রীপুর শিল্পাঞ্চল শ্রমিক দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা কাজল ফকির কাজল ফকির ও পৌর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সেলিম মিয়া। পৌরসভা থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তারা প্রতি দোকান থেকে ১০০ টাকা করে তুলছিলেন। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে হকারদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছিল।
হকার্স কমিটির নেতা জাহিদ হোসেন বলেন, মাওনা চৌরাস্তায় হকারদের কাছ থেকে অব্যাহত চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন শ্রীপুর উপজেলা শাখার উদ্যোগে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছিল। ওই প্রতিবাদের জেরে কাজল ফকির ও সেলিম মিয়া দেড় থেকে দুইশ সশস্ত্র লোক নিয়ে হকারদের ওপর হামলা করেন। তারা আমাকে ও হকার্স কমিটির সভাপতি মামুন মিয়ার মাথায় কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেছেন।
মাওনা চৌরাস্তায় উড়াল সেতুর নিচে সড়কে দোকান বসানো একাধিক অস্থায়ী ব্যবসায়ী জানান, যারা নিয়মিত দোকান বসাচ্ছেন তাদের কাছ থেকে চুক্তি করে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অগ্রিম টাকা নিয়েছেন ইজারাদার কাজল। ইজারাদারের লোকজন প্রত্যেক দোকান থেকে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে চাঁদা তুলছেন। হকারদের রসিদ দিলেও সেখানে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয় না। প্রতিবাদ করলে উচ্ছেদের হুমকি দেন। অথচ ছোটবড় সব দোকান থেকে প্রতি তিন ঘণ্টার জন্য ২০ টাকা করে তোলার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। তবে পৌরসভা থেকে ইজারা দেওয়া হলেও চৌরাস্তার উত্তরের বেশিরভাগ জায়গা তেলিহাটী ইউনিয়ন পরিষদের। বাকি জায়গা সওজের। অন্য প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন এলাকা জোর করে ইজারা দিচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে চলতি বৈশাখের শুরু থেকে প্রতি দোকানে ১০০ টাকা করে চাঁদা নির্ধারণ করে দেন বিএনপির নেতারা। বিএনপি নেতারা ইজারাদার দাবি করে এই চাঁদা নিচ্ছেন। এ নিয়ে হকাররা ক্ষুব্ধ হন। প্রতিবাদ করলে হকারদের সঙ্গে ইজারাদার ও তার প্রতিনিধিদের সংঘর্ষ হয়।
এ বিষয়ে কাজল ফকির বলেন, ‘পৌরসভা থেকে দরপত্রের মাধ্যেমে চৌরাস্তা বাজার ইজারা নিয়েছি। পহেলা বৈশাখ থেকে নিয়মিত আমার লোকজন ইজারার টাকা তুলছেন। কিন্তু জাহিদ নামে এক ব্যবসায়ী বিষয়টি নিয়ে বিরোধিতা শুরু করেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে আমার লোকজন খাজনা তুলতে গেলে তাদের মারধর করা হয়। বিষয়টি আমি উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। থানায় মামলা করেছি।’
উড়াল সেতুর নিচের সড়ক ও ফুটপাত সওজ অধিদফতরের আওতাধীন বলে জানিয়েছেন শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং শ্রীপুর পৌরসভার প্রশাসক সজীব আহমেদ। সওজের জায়গা পৌরসভা ইজারা দিতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিগত ২৩ বছর ধরে চৌরাস্তার অস্থায়ী বাজার ইজারা দিয়ে আসছে পৌরসভা। এখন শিডিউলভুক্ত বাজার ইজারা না দিলে আগে শিডিউল বাতিল করতে হবে। ছোটবড় সব দোকান থেকে প্রতি তিন ঘণ্টার জন্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী টাকা তোলার জন্য ইজারাদারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি এর বেশি তোলা হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত করার পরিবর্তে কেন ইজারা দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘আগামী মাসে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করবো। সভায় উপস্থিত সবাই একমত থাকলে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই বাজারের ইজারা স্থগিত করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে সওজের গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী খ. মো. শরিফুল আলমের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।