তাজা ফল আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাজারে। প্রতি কেজি তাজা ফল ২৫০ থেকে ৫০০ টাকার কমে মিলছে না। ফলে আমদানি করা ফল অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। রমজান ঘনিয়ে এলেও চট্টগ্রামের বৃহত্তম ফলের আড়তে কমেনি দাম। উল্টো আমদানি কমেছে। বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে ফল।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফল আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দামে। ফলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। সরকার গত ৯ জানুয়ারি আমদানি করা তাজা ফলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় দাম বেড়ে গেছে। এতে ফল বিক্রি কমে গেছে। বর্তমানে আমদানি করা ফলে কেজি প্রতি ১৩৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। প্রতি কার্টনে আপেল, কমলা, আঙুর ও মাল্টার দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত।’
তাজা ফল আমদানি
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে আপেল আমদানি হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৯৫১ মেট্রিক টন, কমলা ও মাল্টা আমদানি হয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৯৯ টন, আঙুর আমদানি হয়েছে ২৯ হাজার ৮৮৮ টন ও নাশপাতি আমদানি হয়েছে নয় হাজার ৬৫৩ টন।
একইভাবে চলতি বছর ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (জুলাই ২০২৪ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) আপেল আমদানি হয়েছে ৬৯ হাজার ৪১৫ টন, কমলা ও মাল্টা আমদানি হয়েছে ৮৭ হাজার ২৯৮ টন, আঙুর আমদানি হয়েছে ২৮ হাজার ৭৫৩ টন ও নাশপাতি আমদানি হয়েছে দুই হাজার ৮৫১ টন।
এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই মাসে আপেল আমদানি হয় ছয় হাজার ৬০০ টন, আগস্টে ছয় হাজার ৪৫২ টন, সেপ্টেম্বরে আট হাজার ১০০ টন, অক্টোবরে আট হাজার ৭৭৫ টন, নভেম্বরে ১১ হাজার ৬৯৮ টন, ডিসেম্বরে ১১ হাজার ২২৮ টন, জানুয়ারিতে ১১ হাজার ২০৪ টন ও ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৩৫৮ টন আমদানি হয়। একই অর্থবছরের জুলাই মাসে কমলা ও মাল্টা আমদানি হয় সাত হাজার ৯২৫ টন, আগস্টে আট হাজার ৪৭ টন, সেপ্টেম্বরে ১৭ হাজার ৬৯৩ টন, অক্টোবরে ১৪ হাজার ১৭৩ টন, নভেম্বরে ১০ হাজার ৯৬৫ টন, ডিসেম্বরে ১০ হাজার ৮৩৭ টন, জানুয়ারিতে ১০ হাজার ৩৯৬ টন ও ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত হাজার ২৬২ টন। আমদানি হওয়া আঙুরের মধ্যে জুলাই মাসে দুই হাজার ৬৮০ টন, আগস্টে দুই হাজার ৬৬৯ টন, সেপ্টেম্বরে চার হাজার ৮১৫ টন, অক্টোবরে ছয় হাজার ৮০৩ টন, নভেম্বরে পাঁচ হাজার ৪৮৯ টন, ডিসেম্বরে চার হাজার ৬৮৯ টন, জানুয়ারিতে এক হাজার ৫০৮ টন ও ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০০ টন। এ ছাড়া জুলাই মাসে ১৪৮ টন নাশপাতি, আগস্টে ৪২৩ টন, সেপ্টেম্বরে ৩৩৮ টন, অক্টোবরে ৪৪৪ টন, নভেম্বরে ৬১২ টন, ডিসেম্বরে ৪৪৪ টন, জানুয়ারিতে ২৫২ টন ও ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৯০ টন আমদানি হয়।
আড়তে ফলের দাম
চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন সড়কের ফলের পাইকারি বাজারটি ফলমন্ডি নামে পরিচিত। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ফলমন্ডি আড়তে ১৫ কেজির মাল্টার কার্টন বিক্রি হয়েছে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজি মাল্টা ২০০ থেকে ২২০ টাকা পড়ছে, ২১ কেজির সবুজ আঙুর বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকায়, প্রতি কেজির দাম পড়ছে ২১৫ থেকে ২৩০ টাকা, ২১ কেজির কালো আঙুর বিক্রি হয় পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকায়। কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, চীন থেকে আমদানি করা ২০ কেজির আপেলের কার্টন বিক্রি হয় চার হাজার ৫০০ টাকায়। প্রতি কেজি ২২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ফ্রান্স, ইউক্রেনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা ১৮ কেজির আপেলের কার্টন বিক্রি হয় পাঁচ হাজার ৫০০ টাকায়। প্রতি কেজির দাম ২৭৮ টাকা, নয় কেজির নাশপাতি বিক্রি হয় দুই হাজার ৫০০ টাকায়। কেজি প্রতি পড়ছে ২৭৮ টাকা। আট কেজি প্যাকেটের কমলা বিক্রি হয় এক হাজার ৯০০ টাকায়। এতে কেজি প্রতি দাম পড়ছে ২৪০ টাকা।
খুচরা বাজারে ফলের দাম
পাইকারির চেয়ে খুচরায় প্রত্যেক ফলের দাম কেজি প্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। রাউজান পাহাড়তলী ইউনিয়নের খুচরা ফল বিক্রেতা মো. নুরুল আবছার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়, আপেল ২৭০ থেকে ৩২০ টাকায়, কমলা ২৩০ থেকে ২৭০ টাকা, চায়না কমলা ২৯০ থেকে ৩০০ টাকা, সবুজ আঙুর ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, কালো আঙুর ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। নাশপাতি বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকায়।
আমদানি ফলে শুল্ক কত
ফল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১০ শতাংশ অগ্রিম কর, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ করেছে সরকার। এনবিআরের তথ্যমতে, গাড়ি, মদ-সিগারেটের পর তাজা ফল আমদানিতে সবচেয়ে বেশি শুল্ককর দিতে হয়।
শুল্ককর কমানোর প্রস্তাব বিটিটিসির
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন ১০০ টাকার ফল আমদানি করলে ১৩৬ টাকা শুল্ককর দিতে হয়। সম্প্রতি এই কমিশনের প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়। সেখানে বিদেশি ফল আমদানিতে শুল্ককর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং উচ্চতর শুল্ক ও কর আমদানি করা তাজা ফলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ফলের দামের এই বোঝা পড়েছে ক্রেতাদের ওপর। এতে ৮৬ টাকার ফল আমদানিতে ১২০ টাকা কর দিতে হয়। এই উচ্চ শুল্ক চোরাচালান বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বৈধ আমদানি কমিয়ে দেবে। আমদানি কমলে শুধু ক্রেতারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, সরকারেরও রাজস্ব কমবে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহআলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছর ফল আমদানি কিছুটা কমেছে। আমদানিকারকরা বলছেন, শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে আমদানিতে।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারিতে আপেল আমদানি হয়েছে ১১ হাজার ২০৪ টন এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয় পাঁচ হাজার ৩৫৮ টন। একই সময়ে আগের বছর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমদানি হয় ১৩ হাজার ৬৪ টন, ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজার ৭৮২ টন। একইভাবে কমলা চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমদানি হয় ১০ হাজার ৩৯৬ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে সাত হাজার ২৬২ টন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমদানি হয় ১১ হাজার ৮০১ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে হয় ১০ হাজার ৪৩৫ টন। চলতি বছর জানুয়ারিতে আঙুর আমদানি হয় এক হাজার ৫০৮ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১০০ টন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আঙুর আমদানি হয় ৭৯১ টন ও ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়নি। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে নাশপাতি আমদানি হয় ২৫২ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১৯০ টন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমদানি হয় ৪৪৫ টন এবং ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয় এক হাজার ৩২ টন।’