চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন নগরের বাসিন্দারা। বিভিন্ন এলাকায় দিনের পর দিন পানি আসছে না। আবার যেটুকু আসছে, তার মধ্যে থাকছে শেওলা, কখনও লবণাক্ততা, আবার কখনও নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এভাবে পানি নিয়ে সারা বছর দুর্ভোগে থাকেন গ্রাহকরা। বেশিরভাগ সময় মুখে তোলার জো নেই এই পানি। ঠিকভাবে গোসলও করা যাচ্ছে না। অনেকে পানি কিনে এনে ব্যবহার করছেন।
শেওলার কারণে ওয়াসার দুটি প্রকল্পে দৈনিক চার কোটি লিটার পানির উৎপাদন কমেছে। এতে সংকট বেড়ে গেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত এবং শেওলাযুক্ত পানি নিয়ে দুর্ভোগে রয়েছেন গ্রাহকরা। প্রতি বছর বিল বাড়লেও নগরের বাসিন্দারা পাচ্ছেন না বিশুদ্ধ পানি। এই সংকটকে পুঁজি করে নগরজুড়ে রমরমা ব্যবসা করছে বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
চিকিৎসকরা বলছেন, নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগসহ পানিবাহিত রোগের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই নগরের বাসিন্দাদের এক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।
প্রতিদিন ১৪ কোটি লিটার পানির সংকট
ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরে বর্তমানে দৈনিক ৬০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। ওয়াসা ৪৫ থেকে ৪৬ কোটি লিটার চাহিদা পূরণ করছে। এর মধ্যে কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেইজ-১-এর মাধ্যমে দৈনিক ১৪ কোটি লিটারের সক্ষমতা থাকলেও শেওলার কারণে দুই কোটি লিটার কম উৎপাদন হচ্ছে। একই অবস্থা কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেইজ-২-এর। এই প্রকল্প থেকেও দৈনিক ১৪ কোটি লিটার সক্ষমতার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে ১২ কোটি লিটার। এ ছাড়া মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্পে দৈনিক ৯ কোটি লিটার এবং গভীর নলকূপের মাধ্যমে চার কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ কোটি লিটার পানির সংকট থেকে যাচ্ছে।
পানির সংকটে ভোগান্তি
পানির সংকটে ভোগান্তির কথা জানিয়ে নগরের লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ মোহাম্মদ সবুজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন. ‘গত ১০-১২ দিন লাইনে লাল রঙের পানি আসছে। এই পানি খেয়ে অধিকাংশ বাসায় ডায়রিয়া, বমিসহ লোকজন নানা রোগে আক্রান্ত হয়। গত চার-পাঁচ দিন ধরে পানিতে শেওলা পাওয়া যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসছে। অথচ প্রতি বছর পানির দাম বাড়াচ্ছে ওয়াসা।’
উৎপাদন কমেছে
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন ধরে কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ ও কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-২-এর পানির সঙ্গে শেওলার পরিমাণ বেশি আসছে। দুটি প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীর পানি সংগ্রহ করে তা পরিশোধন করা হয়। প্রকল্প দুটির ১৪ কোটি করে ২৮ কোটি লিটার পানি পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে শেওলার কারণে দুই প্রকল্পে দুই কোটি করে চার কোটি লিটার পানির উৎপাদন কমে গেছে।
নেই কোনও সমাধান
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রবিউল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় এই প্রকল্পের পানিতে শেওলা দেখা যায়। নদীতে ভাটার সময় এই সমস্যাটা বেশি দেখা দেয়। গত কিছুদিন ধরে সমস্যাটা বেড়েছে। মূলত শেওলা আসায় পানির উৎপাদন কমেছে। এতে গ্রাহকদের ভোগান্তিও বেড়ে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী পানি দেওয়া যাচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীতে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শেওলা বেড়ে গেছে। সেই শেওলা ওয়াসার পানিতে আসছে। গত কিছুদিন ধরে ওয়াসার দুটি প্রকল্পে শেওলা দেখা যাচ্ছে। কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-১ ও কর্ণফুলী পানি শোধনাগার প্রকল্প-২-এ শেওলার সমস্যাটা বেড়েছে। এজন্য দুই শোধনাগার প্রকল্পে দুই কোটি করে চার কোটি লিটার পানি সরবরাহ কমেছে।’
পানিতে কেন শেওলা
এ প্রসঙ্গে হালদা নদী গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শীতকালে নদীতে পানি কমে যায়। পানিপ্রবাহ অনেকটাই ধীর হয় যা শেওলা বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। এ ছাড়া শাখা খালের মাধ্যমে নদীতে আসা জৈব পদার্থ বা পুষ্টি উপাদান শেওলা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। অনেকদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কাপ্তাই লেকে পানির স্তর কমে যাওয়ায় শেওলার উৎপাদন বেড়েছে। যা কাপ্তাই লেক ও কর্ণফুলীর শাখা নদীর মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীতে প্রবেশ করে। এসব শেওলা ওয়াসার পানি শোধনাগারের ফিল্টারে জমে ফিল্টারকে ব্লক করে দেয়। ফলে পানি শোধনাগারে সুপেয় পানি উৎপাদন ব্যাহত হয়। আবার পানিতে থাকছে শেওলা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন রাসায়নিক পদ্ধতি যেমন সঠিক পরিমাণ ক্লোরিন, আলগিসাইড, কার্বন ফিল্টার, ফ্লোকুলেশন ও সেডিমেন্টেশন এবং শেওলা খেকো মাছ ব্যবহার করে শেওলা কমানো যেতে পারে।’
শেওলা পানিতে আছে বিপদ
জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত ও শেওলা পানি পানে মানবদেহে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, জন্ডিস, চর্মরোগসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ দেখা দিতে পারে। এজন্য গভীর নলকূপের পানি পাওয়া না গেলে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।’