চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে এসআলম গ্রুপের মালিকানাধীনসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের শাখা থেকে টাকা না পেয়ে খালি হাতে ফিরছেন গ্রাহকরা। প্রতিদিন ব্যাংকে গিয়েও টাকা তুলতে পারছেন না। কোনও কোনও ব্যাংক দিনে গ্রাহকদের ২ থেকে ৫ হাজার টাকা দিলেও বেশির ভাগ শাখাই দিতে পারছে না।
সরজমিনে বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) ন্যাশনাল ব্যাংক মীরসরাই শাখা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক বারইয়ারহাট শাখা, মিঠাছরা বাজার উপ-শাখা, ইউনিয়ন ব্যাংক জোরারগঞ্জ বাজার শাখা, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক করেরহাট শাখা, বারইয়ারহাট উপ-শাখা, বড়তাকিয়া শাখা, আবুতোরাব উপ-শাখা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, গ্রাহকরা টাকা উত্তোলন করতে এসে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। ব্যাংকগুলোতে দিনে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাহক জড়ো হন টাকা উত্তোলনের জন্য। কিন্তু শাখাগুলোতে তারল্য সংকট থাকায় এবং গ্রাহকরা নতুন করে টাকা জমা না দেওয়ায় নগদ টাকার সংকট কাটছে না।
আরও জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) ও রিয়েল-টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) বন্ধ থাকার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং ও এটিএম বুথেও টাকা দেওয়া বন্ধ থাকার কারণে গ্রাহক ভোগান্তি চরমে উঠেছে।
শাখাগুলোতে দেখা গেছে, গ্রাহকরা চেকে স্বাক্ষর করে টাকার অঙ্ক না লিখে তা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে রেখে যাচ্ছেন। যেন ব্যাংকে টাকা জমা হলে সামান্য কিছু হলেও পান।
ন্যাশনাল ব্যাংক মীরসরাই শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, ২০-২৫ জন গ্রাহক জড়ো হয়ে আছেন ব্যাংকটির ক্যাশ কাউন্টার ও ব্যবস্থাপক কক্ষের সামনে। গ্রাহকরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও টাকা পাচ্ছে না। ব্যবস্থাপকের কক্ষ খোলা থাকলেও তিনি উপস্থিত নেই।
টাকা উত্তোলন করতে আসা আক্তার হোসেন নামে এক গ্রাহক বলেন, ৫০ হাজার টাকার একটি চেক নিয়ে গত ২ সপ্তাহ ঘুরছি। ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংকে এসে টাকা না পেয়ে অনেক বিপদে পড়ে গেছি।
জয়নব বিবি চম্পা নামের একজন বলেন, গত রবিবার ২০ হাজার টাকার চেক নিয়ে এলে ব্যাংক থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়। এ সপ্তাহে বলছে, টাকা নেই। বাচ্চারা অসুস্থ থাকায় টাকা না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে।
নাজির আলম নামে এক গ্রাহক বলেন, আমার চার লাখ টাকা জমা আছে। গত কয়েক সপ্তাহ ঘুরেও কোনও টাকা তুলতে পারিনি। অফিসাররা বলেন, ব্যাংকে টাকা নেই। আমাদের কষ্টের জমানো টাকা গেলো কই। সরকারের উচিত গ্রাহকদের বিষয়টি বিবেচনা করা।
ন্যাশনাল ব্যাংক মীরসরাই শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক ওসমান গনি বলেন, আগে প্রতিদিন ২০-৫০ জন গ্রাহক টাকা উত্তোলন করার জন্য আসার পাশাপাশি সমপরিমাণ গ্রাহক টাকা জমা দিতেও আসতেন। কিন্তু বর্তমানে টাকা জমা দিতে কেউ আসছেন না। সবাই শুধু টাকা উত্তোলন করতে আসছেন। গ্রাহকদের মাঝে ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য পৌঁছানোর কারণে সবাই টাকা উত্তোলনের জন্য ভিড় করছেন। তাছাড়া হেড অফিস থেকেও পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা দেওয়া হচ্ছে। যে পরিমাণ টাকা আসে তা ভাগ করে ৫-১০ হাজার করে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মিঠাছরা বাজার উপ-শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, ব্যাংকের মধ্যে সুনসান নীরবতা, নেই কোনও কোলাহল। কিছুক্ষণ পরপর একজন দুই জন করে গ্রাহক আসেন চেক নিয়ে টাকা তুলতে। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সব গ্রাহককে একই কথা বলছেন; টাকা নেই, এলে দেওয়া হবে।
টাকা তুলতে আসা গ্রাহক আবদুস সামাদ বলেন, আমার ৩০ হাজার টাকা জমা আছে, কয়েকদিন ঘোরার পরও টাকা তুলতে পারিনি। টাকা এলে দেবে। কখন দেবে সেটা জানি না।
জিয়া উদ্দিন বাবলু নামে এক গ্রাহক বলেন, আমার অ্যাকাউন্ট সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সোনারগাঁও শাখায়। মিঠাছরা বাজারের উপ-শাখায় বেশ কয়েকবার এসেও টাকা উত্তোলন করতে পারিনি। অনলাইনে চেক পাস করার অনুমতি না থাকায় এখান থেকে টাকা দিচ্ছে না। ঢাকা গিয়েও টাকা পাবো কিনা সেটা জানি না।
গ্রাহক আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের একটি সমিতির ছয় লাখ টাকা জমা আছে। প্রথমে সপ্তাহে পাঁচ হাজার টাকা করে দিলেও এখন তাও বন্ধ রয়েছে। সমিতির টাকা নিয়ে সদস্যরা সবাই খুবই উদ্বিগ্ন।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মিঠাছরা বাজার উপ-শাখার ইনচার্জ মোহাম্মদ আবদুল গফুর বলেন, গত দুই সপ্তাহ পাঁচ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকা হেড অফিস থেকে আসছিল। সেটা দিয়ে গ্রাহকদের ৫-১০ হাজার টাকা করে দিয়েছি। এই সপ্তাহে হেড অফিস থেকে কোন টাকা না আসায় গ্রাহকদের টাকা দিতে পারিনি। গ্রাহকদের মাঝে আতঙ্ক কাজ করায় সব গ্রাহক একসঙ্গে টাকা তুলতে আসতেছেন। কিন্তু নতুন করে গ্রাহকরা টাকা জমা না দেওয়ার ফলে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না।
ইউনিয়ন ব্যাংকের জোরারগঞ্জ শাখায় টাকা তুলতে আসা গ্রাহক আলেয়া বেগম বলেন, গত দুই সপ্তাহ টাকা তুলতে পারিনি। ব্যাংকের অফিসাররা বলছেন তাদের কাছে টাকা নেই। তাহলে আমাদের জমানো টাকা কই গেলো। তাদের পিটালেতো টাকা বের হবে না। তাই প্রতি সপ্তাহে ঘুরে যায় যদি কিছু টাকা হলেও পায়।
লিলি সরকার বলেন, বাচ্চার অসুখ নিয়ে ব্যাংকে এসেছি, টাকা তুলতে। ব্যাংক কোনও টাকা দিচ্ছে না। ওষুধ কিনবো কেমনে?
ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ সানজিদ হোসাইন বলেন, ব্যাংকে গ্রাহক টাকা জমা দিচ্ছেন না। সবাই শুধু নিতে আসেন। আমাদের শাখা থেকে যারা লোন নিয়েছেন তাদের অধিকাংশ মৎস্য চাষি ছিলেন। এবারের বন্যায় অনেকের মাছ ভেসে গেছে। তাই তারাও ঋণের টাকা নিয়মিত পরিশোধ করছেন না। প্রতিদিন গ্রাহকের টাকা জমা প্রদান সাপেক্ষে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। গ্রাহকদের চাপে গতকাল ব্যবস্থাপক অসুস্থ হয়ে পড়েন। আজ তিনি আসেননি। ফলে কোনও টাকাও দেওয়া যাচ্ছে না।
ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক বারইয়ারহাট উপ-শাখায় টাকা তুলতে আসা গ্রাহক মহিউদ্দিন বলেন, দুই সপ্তাহ ঘুরেও টাকা পাচ্ছি না। প্রবাসে থাকা অবস্থায় আমি ব্যাংকে টাকা জমিয়েছি। কষ্টের জমানো টাকা না ফেলে পথে বসা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।
ব্যাংকটির কর্মকর্তা পলাশ জানান, সব গ্রাহক একসঙ্গে টাকা উত্তোলন করতে আসায় চাপ বেড়ে গেছে। করেরহাট মূল শাখায় প্রতিদিন দুই লাখ টাকা আর বারইয়ারহাটের উপ-শাখায় ৪০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয় গ্রাহকদের জন্য। সেখান থেকে ২-৩ হাজার টাকা করে গ্রাহকদের দেওয়া হয়।