X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

রাজমিস্ত্রির টাকায় ১০ স্কুল-কলেজ

আবদুল্লাহ আল মারুফ, কুমিল্লা
১৪ জুলাই ২০২২, ১৫:৫২আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২২, ১৫:৫২

কুমিল্লার মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী, পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে পরিবারের হাল ধরতে ঘর ছাড়েন। তবে নিজের পেশার খোলসে তিনি আবদ্ধ থাকেননি। নির্মাণ কাজের পাশাপাশি তিনি ট্যাক্সি চালান, করেন রঙের কাজ। সর্বশেষ আলোর দিশারী হয়ে নিজ টাকায় গড়ে তুলেছেন ১০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ধান্যদৌল গ্রামে তার বাড়ি।
 
সরেজমিনে তার জন্মস্থান ধান্যদৌল গ্রাম ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ধান্যদৌল গ্রামের আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী ও মোসাম্মাৎ আশেদা খাতুন চৌধুরী দম্পতির প্রথম সন্তান মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী জন্ম নেন। ১৯৭৪ সালে মোশাররফের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী মারা যান। ছয় সন্তানকে বুকে নিয়ে এক জীবনযুদ্ধে নামেন মোশাররফের মা। মোশাররফের চাচা ও মামাদের সহায়তায় কোনোরকমে নুনে-ভাতে চলতে থাকে জীবন। এরইমধ্যে ১৯৮৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর কাতারে চলে যান মোশাররফ। প্রবাসের জীবন সংগ্রাম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার গল্প শোনান মোশাররফ। তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালে কাতারের অবস্থা অতো ভালো ছিল না। পাথর কেটে কেটে কনস্ট্রাকশনের কাজ হতো। এক সময় বড় বড় পাথর টানা দুই দিন বা তিন দিন লাগিয়েও কাটতে হতো। হাতে ফোসকা পড়তো। ফোসকা পড়া হাত নিয়ে কাজ করতাম। সেই ফোসকা ফেটে রক্ত বের হতো। বাসায় এসে রক্ত মুছে ড্রেসিং করে আবার পরদিন কাজে যেতাম। তখন রোদের তাপে অনেক মানুষ মারাও যেতো। অসুস্থ হতাম আবার সুস্থ হতাম। দেখার কেউ ছিল না। রাজমিস্ত্রির কাজে জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে। 

 সেই ঘাম আর রক্ত ঝরানো টাকায় বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ১৯৮৯ সালে দেশে এসে ধান্যদৌল গ্রামে বাবার নামে আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। যেখানে বর্তমানে দেড় হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী আছে। তখন থেকেই আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার নেশা জাগে। বাড়ি আসতাম। দেখতাম ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করছে। আমার আত্মীয় স্বজনেরা শিক্ষিত হচ্ছে। আমার গ্রামের মানুষ তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াতে আগ্রহী হচ্ছে। আমি আবার চলে গেলাম দেশ ছেড়ে। আবার শুরু করলাম সংগ্রাম।

এরপর ১৯৯৪ সালে আম্মা ও দাদির নামে আশেদা-জোবেদা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা গড়ে তুলি। তারপর আবার পাড়ি জমাই প্রবাসে। কেটে যায় আরও পাঁচ বছর। ১৯৯৯ সালে দেশে এসে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরে নিজের নামে প্রতিষ্ঠা করি মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। বর্তমানে সেখানে ১০টি বিষয়ে স্নাতক পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অন্য কলেজের চেয়ে কম নয়। বর্তমানে তিন হাজার শিক্ষার্থী সেখানে পড়ছে। সেই বছরই উপজেলা সদরে সাবেক আইনমন্ত্রীর নামে আবদুল মতিন খসরু মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। বর্তমানে সেখানেও ছাত্রীর সংখ্যা ৭০০-এর ওপরে। ২০০২ সালে নিজের ছেলে মেয়ের নামে মুমু রোহান কিন্ডার গার্টেন নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করি। সেখানে বর্তমানে ৬০০ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে।

এতেই শেষ নয়, ২০১০ সালে ব্রাহ্মণপাড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণে মোশাররফ দান করেন এক বিঘা জমি। জানা গেছে, তার বাবার দাদা মরহুম সিরাজ খান চৌধুরী ১৯৩৭ সালে নিজ গ্রামে ধান্যদৌল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর মরহুম সিরাজ খান নিজেই ছিলেন সেখানকার প্রধান শিক্ষক। এরপর মোশাররফ হোসেন চৌধুরীর বাবা আবদুর রাজ্জাক খান চৌধুরী ১৯৫৭ সালে রাঙামাটি জেলার একটি দুর্গম এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি স্কুল। আর সেটি ছিল ওই এলাকার প্রথম শিক্ষার আলো। এরপর নিজের গ্রাম থেকে শিক্ষক নিয়ে গিয়ে সেখানে চাকরি দেন। মূলত বাবার এই শিক্ষার আলো ছড়াতেই কাজ করে যাচ্ছেন মোশাররফ। 

রাজমিস্ত্রির কাজের পাশাপাশি প্রবাসের রাস্তায় ট্যাক্সিও চালিয়েছেন মোশাররফ তিনি জানান, চালুর কয়েকবছরের মধ্যেই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছে। পেয়েছে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা।

মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে তার সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। যার একটি টাকারও চাহিদা নেই তার। তিনি চান তার গ্রাম হোক একটি নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম। তার গ্রামের সবাই হোক শিক্ষিত, মার্জিত আর শিক্ষার ফেরিওয়ালা। 

মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আবদুস ছালামের। তিনি বলেন, আমি প্রথমে এই শিক্ষানুরাগীকে অভিনন্দন জানাই। সে কি করে, সেটা কোনও বিষয় নয়। কিন্তু তার চিন্তাভাবনা ও কর্মযজ্ঞ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেছে। প্রত্যেকেই তার নিজের অবস্থান থেকে এমন আলোর মানুষদের সঙ্গে থাকা উচিত। শিক্ষার আলো ছড়ানো উচিত। তার জন্য শুভকামনা রইলো। 

 

 

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘নিষিদ্ধের পাশাপাশি আ.লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি তুলতে হবে’
‘নিষিদ্ধের পাশাপাশি আ.লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি তুলতে হবে’
সংসদীয় আসন সংখ্যা ৬০০ করার সুপারিশ নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের
সংসদীয় আসন সংখ্যা ৬০০ করার সুপারিশ নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের
চাঁদপুরে দুই মামলায় আ.লীগ ও যুবলীগের তিন নেতা গ্রেফতার
চাঁদপুরে দুই মামলায় আ.লীগ ও যুবলীগের তিন নেতা গ্রেফতার
কয়েদির পোশাকে সিনেমা হলে শতাধিক ভক্ত!
কয়েদির পোশাকে সিনেমা হলে শতাধিক ভক্ত!
সর্বাধিক পঠিত
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল