২০১৮ সালের ২৪ মে ময়মনসিংহ নগরীর পুরোহিতপাড়া রেলওয়ে পুকুরপাড় এলাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ারে নিহত রাজন হত্যা মামলায় জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক ওসি আশিকুর রহমানসহ ১৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পিবিআই’কে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। রবিবার (২০ এপ্রিল) বিকালে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ নম্বর আমলি আদালতের বিচারক শরিফুল হক এই আদেশ দেন।
এই তথ্য নিশ্চিত করে ময়মনসিংহ আদালতের পুলিশ পরিদর্শক মুসতাসিনুর রহমান জানান, গত বছরের ৩১ অক্টোবর নিহত রাজনের বাবা হারুন অর রশিদ ছেলের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলা গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি আশিকুর রহমানসহ ১৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক নম্বর আমলি আদালতে অভিযোগ দাখিল করেন। ওই মামলায় রবিবার বিকালে বিচারক অভিযোগ তদন্ত করে রিপোর্ট প্রদানের জন্য জেলা পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলায় অন্য আসামিরা হলেন– পুলিশ পরিদর্শক মুখলেসুর রহমান, কনস্টেবল কাউসার হাবীব, কনস্টেবল গুলজার, কনস্টেবল সোহরাব আলী, এসআই ফারুক আহমেদ, এসআই পরিমল চন্দ্র দাস, এসআই আকরাম হোসেন, এএসআই আব্দুল মজিদ, এএসআই জিন্নাত হাসান মানিক, এএসআই জাকির হোসেন, এএসআই জিল্লুর রহমান, কনস্টেবল সাইদুল, কনস্টেবল সেলিম, কনস্টেবল রাশেদুল, কনস্টেবল সানোয়ার ও কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম।
মামলার বিবরণের জানা যায়, ২০১৮ সালের ২২ মে মধ্যরাতে জেলা গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে আরও বেশ কিছু সদস্য পুলিশের পোশাক পরিহিত অবস্থায় নগরীর পুরোহিত পাড়ার হারুন অর রশিদের বাড়িতে এসে তার ছেলে রাজনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আটক করেন। হারুন ছেলেকে আটকের বিষয়টি জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আপনার ছেলেকে কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছুক্ষণ পরে আবার ছেড়ে দেওয়া হবে।’ পরের দিন সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ছেলে রাজন বাড়িতে না আসায় মামলার বাদী হারুন অর রশিদ জেলা গোয়েন্দা অফিসে যান। তিনি আটক ছেলের সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। কোনও তথ্য না দিয়ে দীর্ঘ সময় তাকে বসিয়ে রাখা হয়। পরে রাজনকে দূর থেকে জেলা গোয়েন্দা অফিসের ভেতর লকআপে আটক অবস্থায় দেখতে পান বাবা।
এরপর ২৪ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে হারুন অর রশিদ জেলা গোয়েন্দা অফিসে গেলে ওসি আশিকুর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে রাজনের জীবনের বিনিময়ে দশ লাখ টাকা দাবি করেন এবং হুমকি দেন, রাত ১০টার মধ্যে দশ লাখ টাকা দিতে ব্যর্থ হলে রাজনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হবে। ওসির এমন কথা শুনে বাদী তার পা ধরে জীবন ভিক্ষা চান এবং ছেলেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করেন। এ সময় বাদীকে ডিবি কার্যালয় থেকে বের করে দিয়ে টাকা জোগাড় করে আনতে বলেন। হারুন রাজনকে ছাড়ানোর জন্য চাহিদার টাকা জোগাড় করতে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ওইদিন দিবাগত রাত পৌনে ২টায় পুরোহিতপাড়ার রেলওয়ে পুকুরপাড় এলাকায় লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পান। বাদী হারুন অর রশিদ ঘুম থেকে উঠে রেলওয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখতে পান তার ছেলে রাজনকে হাত বাঁধা অবস্থায় ঘটনাস্থলে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। পরে ডিবির ওসি আশিকুর রহমানের নির্দেশে অন্য বিবাদীরা হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে উপস্থিত লোকজনকে তাড়িয়ে দেন এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যা করার উদ্দেশ্যে রাজনের বুকের নিচে ও পেটে সরাসরি গুলি করলে রাজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরে মৃত রাজনের লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান ডিবি পুলিশ সদস্যরা। পরদিন ২৫ মে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের হাতে লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ।
পরবর্তী সময়ে বাদী কোতয়ালি থানায় গিয়ে ছেলে রাজন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য যান। খবর পেয়ে ডিবির ওসি আশিকের নির্দেশে বিবাদীরা বাদী হারুন অর রশিদকে ধরে নিয়ে যান এবং তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার হুমকি দেন। নিজের জীবন বাঁচাতেই হারুন অর রশিদ মামলা দায়ের করা থেকে বিরত থাকেন। এরপর ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে সরকার পতনের পর দেশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে মামলা করেন।
পিবিআই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করে আদালতে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবে এমনটাই প্রত্যাশা হারুন অর রশিদের। তিনি জানান, ডিবির সাবেক ওসি আশিকুর রহমান তার ছেলে রাজনকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে তার ছোট ভাই আলালকে ওই মামলার এক নম্বর আসামি করেছে এবং আরও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। ওই মিথ্যা মামলাটি বাতিল করার জন্য আদালতের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
মামলার বাদীর আইনজীবী সালাহ উদ্দিন পাঠান বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর বিজ্ঞ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত করার জন্য জেলা পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন। চাহিদা অনুযায়ী ১০ লাখ টাকা না পেয়ে ক্রসফায়ারের নামে ডিবির সাবেক ওসি আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে গুলি করে রাজনকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর নিহত রাজনের চাচা আলালকে ওই মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এই ঘটনাটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরে বিজ্ঞ আদালত নিশ্চয়ই মামলার বাদীর পক্ষে এ বিষয়ে আদেশ দেবেন। বাদী আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।’
মামলার বিষয়ে জানতে ডিবির সাবেক ওসি আশিকুর রহমানের ফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি ।