করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে নির্ধারিত সময়ে ভোট গ্রহণ করতে না পারায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত ৫ আগস্ট সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার একদিন আগে গত ৪ আগস্ট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। গত ৬ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিনি নগরবাসীর সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার দাবি, কাজ করতে গিয়ে দেখছেন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জর্জরিত এই সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তুলে ধরেন সেসব অনিয়মের কথা।
খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘দুর্নীতির একটি অজগর সাপের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধে নেমেছি। এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম খুঁজে পাচ্ছি। যেই কর্মকর্তার নামে বেশি অভিযোগ, তাকে করা হয়েছে পুরস্কৃত। দেওয়া হয়েছে একাধিক বিভাগের দায়িত্ব। এখানে তেল চুরি করা হয়। কাজ না করেই লোকজন বেতন নিচ্ছেন। এস্টেট শাখার প্রধানের পরিবর্তে উপ-প্রধানের স্বাক্ষরে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে করপোরেশনের জায়গা লিজ দেওয়া হয়।’
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার অভিযোগ সিটি করপোরেশনে অনেকেই কাজ না করেই বেতন নিচ্ছেন। বিষয়টা কি ব্যাখ্যা করবেন?
খোরশেদ আলম সুজন: পরিচ্ছন্নতা বিভাগে ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহ কর্মসূচিতে দৈনিক ভিত্তিতে প্রায় দুই হাজার লোক নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক মেয়র। এই লোকগুলো নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কাউন্সিলরদের বলেছেন তার ওয়ার্ডে লোক নিয়োগ দিতে। তারা ২৫/৩০ জন করে নাম দিয়েছেন। ওই লোকগুলো কাজ না করে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। এরা ভুতুড়ে শ্রমিক। তারা অশরীরী, তাদের দেখা যায় না। কিন্তু তারা বেতন খাচ্ছে। আমার কাছে এমনও তথ্য আছে, এসব লোকের মধ্যে অনার্স-মাস্টার্স পাস করা অনেকের নামও আছে। তারা বাস্তবে কাজ না করেই টাকাগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। আমার নিজস্ব টিম এসব অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আমার টিমের তথ্যও আমি করপোরেশনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবো না। তাই এই বিভাগের অনিয়ম তুলে আনতে আমি করপোরেশনের লোক দিয়ে একটি টিম করে দিয়েছি। তারা অনুসন্ধান করে আমাকে একটি প্রতিবেদন দেবেন। ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে আমরা অভ্যন্তরীণ তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখবো। আমার ধারণা, কেবল পরিচ্ছন্নতা বিভাগ নয়, সবখানে এ ধরনের অনিয়ম হয়েছে।’
বাংলা ট্রিবিউন: যান্ত্রিক বিভাগে কি কোনও ধরনের অনিয়ম পেয়েছেন?
খোরশেদ আলম সুজন: তেল চুরি হচ্ছে। আমি অভিযোগ পেয়েছি, এখানে দুর্নীতি হয়েছে। এবং দুর্নীতি হয়েছে এটি সত্যও। হাতেনাতে ধরাও পড়েছে। কিন্তু আমাকে তো অফিশিয়ালি এটা প্রমাণ করতে হবে। তাই আমি এখন অনিয়ম-দুর্নীতি তল্লাশি করতেছি। এছাড়া যার নামে অনেক বেশি অভিযোগ, ওই কর্মকর্তাকে বেশি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: অভিযোগ রয়েছে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাতে দোকান বসানো হয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
খোরশেদ আলম সুজন: বিপ্লব উদ্যানে এক গণ্ডা জায়গার দাম প্রায় এক কোটি টাকা। সেখানে প্রায় ২০ গণ্ডা জায়গা আছে সিটি করপোরেশনের। এই জায়গা একজনকে ২০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন করবে বলে ওই লোক লিজ নিয়েছে। বাস্তবে দেখা গেছে, কতগুলো দোকান বানানো হয়েছে। সেখানে ৭০/৮০টা গাছ ছিল, ওইগুলো কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনও কাজই করা হয়নি। করপোরেশনের জায়গা লিজ দেওয়া, দেখভাল করা এস্টেট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব। ওই ডিপার্টমেন্টের প্রধানের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তিনি জানিয়েছেন, তাকে এসব বিষয়ে জানানো হয়নি। তাকে অন্ধকারে রেখে এই বিভাগের আরেকজন কর্মকর্তাকে দিয়ে এসব জায়গা লিজ দেওয়া হয়েছে। প্রধান এস্টেট কর্মকর্তার অবর্তমানেই অন্য কর্মকর্তা কি সিগনেচার করতে পারেন? কিন্তু, প্রধান এস্টেট কর্মকর্তা তো ছিলেন। তিনি থাকার পরেও তাকে বাদ দিয়ে অন্য কর্মকর্তাকে দিয়ে লিজ দেওয়ার মানে সামথিং ইজ রং। নিশ্চয়ই এখানে কোনও গলদ আছে। সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পগুলো বাতিল করতে আমি মন্ত্রণালয়ে লিখবো।
তিনি বলেন, নগরবাসীর দাবি হচ্ছে ফুটপাত হকারমুক্ত করা। সিটি করপোরেশন সেটি নিয়ে কাজও করেছে। গতকালও আমি বিষয়টি নিয়ে হকারদের সঙ্গে মিটিং করেছি। তারা আমাকে কথা দিয়েছেন, তারা বিকেল ৩টায় গাড়ি নিয়ে আসবেন। রাত ৯টায় চলে যাবেন। কিন্তু, করপোরেশন যদি নিজেই সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাতে দোকান বসানোর সুযোগ করে দেয় তাহলে কি আমরা হকারদের সঙ্গে জোর গলায় কথা বলতে পারি? আয়বর্ধক প্রকল্প নাম দিয়েও কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন সাবেক মেয়র। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এগুলো থেকে কোনও আয় হয়নি। এখন উল্টো অনেক ঋণ রেখে গেছেন।
বাংলা ট্রিবিউন: সাবেক মেয়র কত টাকা ঋণ রেখে গেছেন? তিনি চাইলে কি ঋণ না রেখে যেতে পারতেন?
খোরশেদ আলম সুজন: সাবেক মেয়র এক হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ রেখে গেছেন। কন্ট্রাক্টরদের পাওনা সাড়ে ৭শ’ কোটি টাকা, অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্র্যাচুইটি বাবদ পাওনা আছেন দেড়শ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিল বাকি আছে ২৯ কোটি টাকা। এর বাইরেও অনেক ঋণ আছে, যেমন করপোরেশনের উদ্যোগে করোনা আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে। করোনা আইসোলেশন সেন্টার বাবদ ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু এরপরও সেখানে কর্মরত ডাক্তার নার্সদের বেতন দেওয়া হয়নি। এই ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা নাকি ডাক্তাররা বিভিন্ন হোটেলে ছিল ওই বাবদ খরচ হয়েছে!
সাবেক মেয়র চাইলে ঋণ না রেখে যেতে পারতেন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, সাবেক মেয়র কিছু বাড়তি ব্যয় করেছেন। চাইলে তিনি এসব ব্যয় কমাতে পারতেন। তাহলে করপোরেশনের এত ঋণ থাকতো না। যেমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তিনি দৈনিক ভিত্তিতে ২ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের অনেকেই কাজ না করেই বেতন নিয়েছেন। সেখানে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে, আমি এটি বের করার চেষ্টা করতেছি। আইসোলেশন সেন্টার, উনার এটিও করার দরকার ছিল না। এর বাইরেও উনি যদি মিতব্যয়ী হয়ে করপোরেশন পরিচালনা করতেন তাহলে এত টাকা ঋণ থাকতো না। এ দায় তো আর সাবেক মেয়রের নিজের না। এ দায় সিটি করপোরেশনের, এ দায় নিয়ে আমাকে কাজ করে যেতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: এই এক হাজার কোটি টাকার ঋণ আপনি প্রশাসক হিসেবে কীভাবে পরিশোধ করবেন?
খোরশেদ আলম সুজন: প্রয়াত সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালে বেশ কিছু আয় বর্ধক প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। উনার পরে যারা মেয়র হয়েছেন, তারা এসব প্রকল্প ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিয়েছেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী বর্জ্য থেকে সার তৈরির কারখানা করেছিলেন, উনার সময় স্বাস্থ্য বিভাগ লাভজনক খাত ছিল। কিন্তু এখন লোকসানের খাতে পরিণত হয়েছে। তখন মহিউদ্দিন চৌধুরী সরকারকে বলেছিলেন, আপনারা আমার প্রকল্পের ফাইলগুলো পাস করিয়ে দেন। তাহলে আপনাদের করপোরেশনের জন্য আর অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে না। এখন আমি মনে করি, এরকম কিছু আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিলে পাশাপাশি সরকার যদি সাপোর্ট দেয় তাহলে এসব ঋণ পরিশোধ করা খুব কঠিন হবে না। করপোরেশনের আয় দিয়েই করপোরেশন চলতে পারবে।
বাংলা ট্রিবিউন: করপোরেশনের আয় বাড়ানোর ব্যাপারে আপনি নিজে কোনও পরিকল্পনা করছেন কি? শুধুই কি হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপরে নির্ভর করবেন?
খোরশেদ আলম সুজন: না, শুধুই হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপরে নির্ভর করে সিটি করপোরেশনের দায়দেনা পরিশোধ করে সামনে এগুনো সম্ভব হবে না। তাই আয়বর্ধক কিছু বিষয় নিয়ে ভাবছি। আপনারা জানেন, একজন মধ্যবিত্ত মানুষ যার এই শহরে একটি ফ্ল্যাট বা দালান আছে, তিনি বছরে ১৭ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স দেন। এখান থেকে সিটি করপোরেশনের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় হয়। তবে এটা যথেষ্ট নয়। তবে আমাদের রয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। আর এই শহর দিয়েই দেশের সিংহভাগ আমদানি রফতানি ব্যবসা হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে আমাদের নজর বাড়াতে হবে।
দেখুন, একজন সাধারণ নাগরিক সিটি করপোরেশনকে যে হারে হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি এই ১৭ শতাংশ হারেই হোল্ডিং ট্যাক্স দেয় তাহলে তাদের কাছ থেকে করপোরেশনের আয় হবে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। অথচ তারা এখন দিচ্ছে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা। আবার বন্দরের ট্রাক লরির কারণে নগরীর সড়কগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নগরীর প্রায় ৯০ ভাগ সড়কই ব্যবহার করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর জন্য যদি বন্দর কর্তৃপক্ষ করপোরেশনকে ছোট একটি ডেভেলপমেন্ট ট্যাক্স দেয় তাহলে ওই খাত থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা চলে আসে। আবার চট্টগ্রাম কাস্টমস দিয়ে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি রফতানি হয়। এই ক্ষেত্রে কাস্টমসের প্রতিটি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে যদি দশমিক পাঁচ শতাংশ করে ডেভেলপমেন্ট ট্যাক্স নিতে পারি তাহলে এই দুই জায়গা থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা করপোরেশনের আয় হবে। তখন নগরীর গরিব জনগণের ওপর হোল্ডিং ট্যাক্সের বোঝা না চাপিয়েও করপোরেশন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এসব বিষয়ে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। সরকারের মনোভাব জানবো।
বাংলা ট্রিবিউন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
খোরশেদ আলম সুজন: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।