গান কবিতার ছন্দে মধুমতি নদীর অনেক নাম, অনেক গল্প কাহিনী লেখা হয়েছে এই নদীকে ঘিরে। তবে বাস্তবে বন্যার সময়ে পদ্মার শাখা হয়েও এই মধুমতি নদী হয়ে ওঠে অসম্ভব আগ্রাসী। তখন টের পাওয়া যায় এর সর্বনাশা রূদ্র রূপ। বিশেষ করে মাগুরার মহম্মদপুর এলাকার অধিবাসীরা এই নদীর বর্ষাশাসনটা টের পান প্রতি বছরেই।
মহম্মদপুরের মানুষের কাছে গান-কবিতা দূরে থাক, মধুমতি যেন এখন নিয়মিত দুঃখের কারণ। গত কয়েক বছরে এই উপজেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত পদ্মার শাখা মধুমতির অব্যাহত ভাঙনে অন্তত ১০টি গ্রামের বড় অংশ বিলীন হয়েছে। আর গত কয়েকদিনে দেড় হাজার একর আবাদি জমি, গাছপালা, বসতভিটা মসজিদসহ কয়েকশ’ স্থাপনা গ্রাস করেছে মধুমতি। অথচ দেখার যেন কেউ নেই।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বর্ষা মৌসুমে নদী তীরবর্তী তিনটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের লোকজনের মধ্যে এখন বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। এসব এলাকায় ভাঙনে প্রতিদিনই বিলীন হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা। উপজেলার বালিদিয়া ইউনিয়নের হরেকৃষ্ণপুর, সদর ইউনিয়নের গোপালনগর, কাশিপুর, রায়পাশা, ভোলানাথপুর, পাচুড়িয়া, রুইজানী ও পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের ঝামা, আড়মাঝি, যশোবন্তপুর গ্রামগুলো তীব্র ভাঙন কবলিত। এসব এলাকার নদী তীরের কয়েকশ’ বসতবাড়ি ইতোমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গছে। অসংখ্য স্থাপনা বসতঘর, কৃষিজমি ও গাছপালা হুমকির মুখে রয়েছে। নদী ক্রমেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দিকে এগিয়ে আসছে। ২০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এ বাঁধ ভেঙে গেলে হুমকির মুখে পড়বে উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বালিদিয়া ইউনিয়নের হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের খবির ডাক্তার বলেন, মধুমতির ভাঙনে এসব এলাকার অনেক অবস্থাপন্ন পরিবার এখন নিঃস্ব, পরের জমিতে আশ্রিত। কেউ দিনমজুর কিংবা নৌকার মাঝি। কোনও বাড়ির ভিটিই পাকা নয়। নদীভাঙনে পাঁচ থেকে সাতবার বসত ভিটা সরিয়ে নিয়েছেন এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। অনেকে সহায়সম্বল হারিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র।
নদীপাড়ের এক নারী রাবেয়া বেগমের চোখে রাজ্যের অন্ধকার। ‘শেষ সম্বল ভিটেটাও যদি নদীতে বিলীন হয়ে যায় তাহলে কোথায় যাবো?’, তার প্রশ্নটার কোনও জবাব নেই তাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
আশেপাশের বাকি সবাই যেন রাবেয়া কিংবা খবির ডাক্তারের মতোই উদভ্রান্ত। খানিক এগুলে ধুলজুড়ি গ্রাম। গ্রামের নাম বদল হলেও নদীর ধারের দৃশ্যপট একই। নদীর পাড় ভাঙছে আর পাড়ের বাসিন্দাদের চোখে যেন ফুটে উঠছে অজস্র তারা কিংবা সর্ষে ফুল!
এই এলাকার এক বাসিন্দার নাম ফারুক হোসেন খাঁন। পাশে দাঁড়াতে গ্রাম আর নদীর দিকে আঙুল তুলে জানালেন, এক সময় অনেকেই অবস্থাপন্ন ছিলেন এই গাঁয়ে। চোখের সামনে শেষ সম্বল বাপ-দাদার ভিটে নদীতে বিলীন হতে দেখছি আমরা। অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছি প্রত্যেক বছর। খালি শুনি বাঁধ হবে, নদী শাসন হবে, গ্রাম রক্ষার ব্যবস্থা হবে। নাহ! শুধু শুনেই গেলাম, কিছু হতে দেখছি না। কিছুই না।
নদীর ধার ঘেঁষে আরেকটা গ্রামের নাম রুইজানি। মোবাইল ফোনে এ গ্রামের প্রিয়নাথের সঙ্গে কথা হয়। মলিন কণ্ঠে বলেন ‘আমাদের জমিজমা যা ছিল মধুমতি সব কেড়ে নিয়েছে। আছে শুধু বসতভিটা। হয়তো শেষরক্ষাও আর হবে না।’
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) ভাঙনরোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মিজানূর রহমান জানান, মধুমতির ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। আশাকরি কিছু একটা হবে।
মাগুরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সরোয়ার জাহান সুজন বলেন, মধুমতির ভাঙন প্রতিরোধের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। অর্থ বরাদ্দ পেলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।