সকাল হলেই শ্রমিকরা বিভিন্ন গ্রামের ঝোপঝাড়ে নেমে পড়েন। হাতে দা, কুড়াল, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আশপাশের বনজঙ্গল ও পরিত্যক্ত জায়গা থেকে কাটতে শুরু করেন হেলে পড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া কলাগাছ, কলাগাছের শুকনা খোল। গ্রামের পুকুর, খাল, বিল, নদী, নালা, ডোবার ভাসমান কচুরিপানা তুলে আনেন। বাঁশও সংগ্রহ করেন তারা। এসব সংগ্রহ করে নিয়ে গুদামে রাখা হয়। পরে উপকরণগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণে কেটে, রোদে শুকিয়ে, প্রসেসিং করে সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো থেকে তৈরি হয় ব্যাম্বু স্লিপস, ব্যাম্বু কোয়াটার লং, ব্যাম্বু কোয়াটার শর্ট, স্লাইডার ইত্যাদি। প্রয়োজনমতো এগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডে। উত্তরা ইপিজেডে ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেড নামের শিল্প কারখানায় এসব কাঁচামাল থেকে তৈরি করা হয় কফিন। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এখানে তৈরি কফিনগুলো। এই পণ্য রফতানি করে ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন বছরে আয় করছে ২৫ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে উত্তরা ইপিজেডের ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেড নামের এই কফিন কারখানার যাত্রা শুরু হয়। প্রায় দেড়শ শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কাঁচামাল সংগ্রহের সুবিধার জন্য ২০১৩ সালে জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মিচাপ ইউনিয়নের দূর্বাছড়ি গ্রামের শিশাতলীতে একটি শাখা প্রতিষ্ঠান খোলে তারা। এর নাম ইকো সাপ্লাইজ (ইএসএন)। এই ইএসএন স্থানীয় লোকদের দিয়ে পরিত্যক্ত কলাগাছ ও কচুরিপানা সংগ্রহ এবং এগুলো প্রসেসিং করে।
শিশাতলীতে জনতা বহুমুখি সমবায় সমিতির নিজস্ব তিন একর জমি চুক্তিতে নিয়ে কাজ শুরু করে ইএসএন। সেখানে প্রতিদিন ৪৬ জন নারী-পুরুষ কাজ করে থাকেন। তাদের দৈনন্দিন মাথাপিছু মজুরি আড়াইশ টাকা।
ওই ইউনিয়নের লক্ষ্মিচাপ পূর্ব ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও কারখানার শ্রমিক সুধির চন্দ্র রায় (৪৭) বলেন, ‘আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে মজুরির টাকার জন্য বাজারে বসে থাকতে হতো। এখন এই কারখানায় কাজ করে টাকা ও কাজের জন্য ভাবতে হয় না। প্রতিদিন বিকালে মজুরির টাকা নিয়ে সময়মতো বাজার করে বাড়ি চলে যাই। এটা আমাদের জন্য অনেক ভালো।’
একই ইউনিয়নের কাছাড়ীপাড়া গ্রামের সুনিল চন্দ্র হাজেরা (৬০) বলেন, ‘আজকাল গ্রামে কাজ পাওয়া যায় না। এই কারখানা হওয়ায় পর থেকে কাজ নিয়ে ভাবতে হয় না। আমার মতো অনেক গরিবলোকের সংসার চলছে এখানে কাজ করে।’
কারখানার শ্রমিক অনিতা রানী বলেন, ‘কলার ছোবরার রশি তৈরি, কাঞ্চন পাতার পেস্ট তৈরি, বাঁশের চাটাই তৈরি করাসহ হরেক রকমের কাজ করতে হয়। আমরা এই কারখানায় কাজ করে সংসারের অনেক উন্নতি করেছি। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে। এখন খুব ভালো আছি।’
সদরের লক্ষ্মিচাপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, ‘আগে এই ইউনিয়নের মানুষের খুব অভাব ছিল। হাতে ছিল না কাজ। বেকারের সংখ্যাও ছিল অনেক। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও ও উত্তরা ইপিজেডের কফিন কারখানার সহযোগিতায় এখন অনেক মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন গ্রামের অবহেলিত নারীরাও। এখন তারা সচ্ছল জীবনযাপন করছেন।’
ইকো সাপ্লাইজ শিশাতলী অফিসের ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কফিন তৈরির জন্য গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পরিত্যক্ত কলাগাছ, কচুরিপানা, কিছু কাঞ্চন ফুল, কিছু বাঁশ সংগ্রহ করে থাকি। এসব সংগ্রহ করতে আমাদের তেমন অর্থ ব্যয় হয় না। শুধু বাঁশ কিনতে হয়।’
ইপিজেড ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেডের সাপ্লাই চেইন কমার্শিয়াল ম্যানেজার এলেন ফেইত ফুলেল বলেন, ‘আমরা বেকারদের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌন্দর্য রক্ষা,পাশাপাশি বৈদেশিক আয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে বছরে আমাদের অন্তত ২৫ কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে।’
ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ইভান্স হালদার বলেন, ‘পরিত্যক্ত কলাগাছ, কচুরিপানা, বাঁশ, ফুল থেকে প্রসেসিং করে কাঁচামাল সংগ্রহ করে কফিন তৈরি করে থাকি আমরা। কফিনগুলো বিদেশে রফতানি করা হয়। এটি স্বল্প বিনিয়োগের এবং ঝুঁকিমুক্ত ব্যবসা।’