যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় প্রধান সড়কের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বহুতল একটি বাড়ি। নিচতলায় গাড়ি পার্কিংয়ের বিশাল জায়গা। সামনের দিকে মাটি থেকে দোতলা পর্যন্ত নয়নাভিরাম তিনটি শো পিলার। মোঘল স্থাপত্য নির্মাণশৈলীর অনুকরণে নকশা বিভিন্ন স্থানে। নির্মাণকাজ এখনও চলছে। ‘রাশিদা মহল’ নামের এই বাড়িকে ঘিরে পৌর এলাকায় আলোচনা বিভিন্ন মহলে। বাড়ির মালিক পাসপোর্ট অফিসের গাড়িচালক মহসীন হোসেন ও তার স্ত্রী একই অফিসের অফিস সহকারী (স্টেনো) রাশিদা বেগমের কর্মকাণ্ডও আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্ত্রীর সহযোগিতায় মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) জাল করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন মহসীন। এসব জাল পাসপোর্ট জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কাছে সরবরাহ হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে মহসীন হোসেন ও রাশেদা বেগম দম্পতির বাড়ি নিয়ে সাংবাদিকরা খোঁজখবর শুরু করার পরপরই গত ২৭ অক্টোবর ওই বাড়ির নামফলকটি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
আলোচিত ওই বাড়িটির পাশেই থাকেন পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আজিজুল কামাল সুইট। বছর দশেক আগে আজিজুল কামাল সুইটদের কাছ থেকে ৯ শতক জমি কেনেন মহসীন হোসেন। সেসময় প্রায় ৩০ লাখ টাকায় জমিটি বিক্রি হয়। তবে সীমানা ছাড়িয়ে বর্তমানে বাড়িটির শোপিলার পৌরসভার জায়গায় পড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
আজিজুল কামাল সুইট বলেন, ‘সীমানা অতিক্রম করায় তখন বাড়ির নির্মাণকাজে বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু অঢেল টাকার মালিক মহসীন তার কোনও এক স্বজনের মাধ্যমে পৌরসভা থেকে প্ল্যানটি পাশ করিয়ে আনেন। পরে পৌরসভার ওই জায়গার ড্রেনটি একটু বাঁকা করে তৈরি করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘উনি সচিবালয়ে একটি বড় পদে চাকরি করেন বলে জানতাম। ঢাকা থেকে যশোরে এলে দামি গাড়ি নিয়েই আসতেন।’
যেভাবে রাশিদা মহল
যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় প্রধান সড়কের পাশের রাশিদা মহলকে ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাশিদা মহলের নিচতলার একটি বড় অংশ পার্কিংয়ের জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি নিচতলায় সনি-এরিকসন ও এয়ারটেল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রজেক্ট মনিটরিং অফিস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। বাড়ির মালিক পাসপোর্ট অধিদফতরের গাড়িচালক মহসীন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্ত্রীর সহযোগিতায় তিনি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) জাল করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। পাসপোর্ট অধিদফতরের তদন্তেও সম্প্রতি তাদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। ফলে রাশিদা খাতুনসহ পাসপোর্ট জালচক্রের কয়েকজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট অধিদফতরের তদন্তে উঠে এসেছে, মহসীন একটি চক্রের মাধ্যমে বিশেষ কায়দায় একই ব্যক্তির একাধিক পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়ার কাজ করতেন। প্রতিটি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে আদায় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। গাড়িচালক মহসীন ও তার স্ত্রী রাশিদা অধিদফতরের তিন কর্মচারী আলী আশরাফ, মাহামুদুল হাসান ও লিখন খানের সহযোগিতায় পাসপোর্ট জাল করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব জাল পাসপোর্ট জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কাছে সরবরাহ হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
স্বজনরাও অবহেলায়
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের খেদাপাড়া বাজারের পাশে হাইস্কুলের গা ঘেঁষে রয়েছে মহসীন হোসেনের পারিবারিক দোতলা বাড়ি। তার বাবা মুনসুর আহমেদ ভূঁইয়া (৯০) জানান, গত ২১ বছর ধরে তারা খেদাপাড়ায় আছেন। এর আগে তিনি একই উপজেলার রোহিতায় বসবাস করতেন। ১৯৬৩ সালের দিকে তারা এখানে বসতি শুরু করেন। তাদের আদি নিবাস নোয়াখালী। দেড় বিঘার জমির ওপর তাদের এই দোতলা বাড়ি; পাশে আরেকটি একতলা বাড়ি হচ্ছে। সেটি তার ছোট ছেলের বলে জানান মহসীনের বাবা।
মুনসুর আহমেদ ভূঁইয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধের বছর খানেক আগে তার বিয়ে হয় রওশনারা বেগমের সঙ্গে। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মহসীন সবার বড়। অন্য দুই ছেলে রঙমিস্ত্রির কাজ করেন বলে তিনি জানান।
মহসীন হোসেনের চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে মুনসুর আহমেদ ও তার স্ত্রী রওশনারা অভিযোগ করেন, ‘ছেলে আমাদের খোঁজ-খবর নেয় না। মাঠে বিঘে দুয়েক জমি আছে। সেই জমির ফসল আর ছোট দুই ছেলের আয়ে কোনওরকমে সংসার চলে আমাদের।’
তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যে মোবাইল ফোনের নাম্বার চাওয়া হলে তারা জানান, মোবাইল ফোন কেনার মতো অবস্থা তাদের নেই!
কথা বলার একপর্যায়ে জানা যায়, রওশনারা বেগম আর মহসীনের শাশুড়ি ফিরোজা বেগম আপন বোন। মহসীন ও তার স্ত্রী রাশিদা পরস্পর খালাতো ভাইবোন।
দান-খয়রাত
বাবা-মা ছেলের কাছ থেকে কোনও সাহায্য না পাওয়ার অভিযোগ করলেও এলাকায় ‘দান-খয়রাত’ করেন মহসীন-রাশিদা দম্পতি। তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়েই খেদাপাড়া পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দোতলা এই স্কুলে পড়াশুনা করতেন রাশিদা। ২০০৯ সালে মহসীন হোসেন সেই স্কুলে ‘রাশিদা মেমোরিয়াল ছাত্রী কমন রুম’ নামে একটি একতলা ভবন তৈরি করে দেন। শুধু তাই নয়, এই এলাকার মাতৃভাষা কলেজ, স্থানীয় ঈদগাহসহ বিভিন্ন স্থাপনা সংস্কার ও গালদহ এলাকায় মাদ্রাসার জন্য জমি কিনে দিয়েছেন তিনি।
খেদাপাড়া বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, মহসীন তার স্ত্রী রাশিদার নামে গত বছর তালতলা এলাকায় রাস্তার ধারে সাড়ে তিন বিঘার মতো জমি কিনেছেন। তাদের বেশ কয়েক বিঘা জমিও আছে মাঠে। তাছাড়া তিনি প্রতি ঈদে এলাকায় এসে গরিবদের মাঝে টাকা-পয়সা, জামা-কাপড়ও বিলি-বণ্টন করেন। সামান্য সরকারি চাকুরে এই দম্পতি এলাকায় এতো সম্পদের মালিক কীভাবে হলো এমন প্রশ্ন তাদেরও।
তিনি জানান, রাশিদা তার বাবা রফিকুল্লাহ চেয়ারম্যানের দ্বিতীয়পক্ষের সন্তান। পারিবারিকভাবে সম্পদের তেমন কিছুই পাননি রাশিদা। তার সৎভাই নজরুল ইসলাম এলাকায় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা চালান।
খেদাপাড়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি লোকমান হোসেন বলেন, ‘এই ইউনিয়নের বেশিরভাগ মানুষের আদি বাড়ি নোয়াখালীতে। মহসীন সাহেব খুব ভালো মানুষ। তিনি গরিব মানুষদের সহযোগিতা করেন। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় সহায়তা করেন। বাড়ির পাশে একটি হেফজখানা তৈরি করছেন। সেটির ছাদ ঢালাইও হয়ে গেছে। আমিও এই মানুষটার (মহসীনের) কাছ থেকে চিকিৎসাবাবদ ১০ হাজার টাকা পেয়েছি।’
খেদাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি সরদার মুজিবর রহমানও তাদের পরিবারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘রাশিদার বাবা এখানকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তারা খুব সৎ; নামাজ-রোজা করেন। সাধ্যমতো গরিবদের সহায়তাও করেন।’
কথায় কথায় তিনি বলেন, ‘একসময় যখন হাতে লেখা পাসপোর্ট ছিল, তখন অফিসের কর্মচারীদের উপরি কিছু আয় হয়েছে- এটা সত্যি। কিন্তু মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট শুরু হওয়ার পর এখন আর সেই সুযোগ নেই।’
মহসীনের বক্তব্য
এসব বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ হয় মহসীন হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৯৯ সালে পাসপোর্ট অফিসে গাড়িচালক পদে চাকরিতে যোগদান করেন। তার স্ত্রী রাশিদা একই অফিসে ২০০৪ সালে স্টেনোগ্রাফার পদে চাকরিতে যোগ দেন। তাদের দুজনের মাসে গড়ে ৬০ হাজারের মতো টাকা আয় হয়।
যশোর শহরের ওই বাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জমিটি আমার শ্বশুর কিনে দিয়েছিলেন। এখানে জমি প্রায় সাড়ে তিন কাঠার মতো। ৫ তলা ফাউন্ডেশনে বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। পঞ্চম তলা এখনও কমপ্লিট হয়নি।’বাড়ি তৈরি করতে তিনি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং তার সৌদি আরব প্রবাসী ছোটভাই ইসমাইল হোসেন টাকা দিয়েছেন বলে জানান।
তবে ছোটভাই ইসমাইল সম্পর্কে মহসিন ও তার বাবা মুনসুর আহমেদ ভূঁইয়ার তথ্য একেবারেই বিপরীত। মহসীন ইসমাইলকে সৌদি প্রবাসী বলে দাবি করলেও তার বাবা মুনসুর আহমেদ ভূঁইয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহসিনের ছোট দুই ভাই দেশেই থাকেন এবং রঙমিস্ত্রির কাজ করেন। টেনেটুনে তাদের সংসার চলে। যদিও ইসমাইলও খেদাপাড়ায় একতলা বাড়ি বানাচ্ছেন।
এলাকায় গরিব মানুষদের মাঝে টাকা-পয়সা, শাড়ি-কাপড় ইত্যাদি বিতরণ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু সহযোগিতা আমরা করি।’ স্কুলের ভবন নির্মাণ, কলেজে সহায়তা, ঈদগাহ নির্মাণ এবং মাদ্রাসায় জমিদানের বিষয়টিও তিনি স্বীকার করেন।
বাবা-মাকে সাহায্য করেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় ব্যস্ততার কারণে বাড়ি রেগুলার যাওয়া হয় না। বছরে এক বা দুইবার যাই। আর বাড়িতে থাকা ছোটভাই এবং সৌদিপ্রবাসী ভাই সংসারের খরচ দেন। আমিও মাঝেমধ্যে কিছু দিই। বাবা-মাকে সহযোগিতা করবো না—তা কী হয়। তবে, সংসারের খরচ বেশি একটা দেওয়া লাগে না।’
মহসীন আরও বলেন, ‘আমার শ্বশুর খেদাপাড়া ইউনিয়নের এক সময়ের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। তিনি বেশকিছু জমির মালিক ছিলেন। তাছাড়া আমার বাবা নোয়াখালী থেকে এখানে আসার সময় সেখানকার সম্পদ বিক্রি করেছিলেন।’ রাশিদা মহল থেকে প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ তিনি ২৩ হাজার টাকা পান বলেও জানান।
রাশিদা মহলের নেমপ্লেট কেন ভাঙলেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই নাম নিয়েই ঝামেলা। সেকারণে বাড়ির মালিকই তা সরিয়ে দিয়েছেন।’
তবে মহসিন-রাশিদা দম্পতির বিরুদ্ধে পাসপোর্ট অধিদফতরের তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটির প্রধান পাসপোর্ট অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানুর সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদ রেজওয়ান তদন্ত কমিটির বিষয়টি স্বীকার করেন। অবশ্য এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি।
এফএস/টিএন/ আপ-এপিএইচ/
আরও পড়ুন:
কুষ্টিয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জেএমবি নেতা নিহত
আ. লীগের ব্যানার-পোস্টার সরানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের!