জেনেভা, ২০৫০– একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন কনফারেন্স রুমে, একটি হলোগ্রাফিক মানচিত্র বাস্তব-সময়ের সংকট নিয়ে জ্বলজ্বল করছে: ডুবে যাওয়া দ্বীপপুঞ্জ, এআই-চালিত বাণিজ্যযুদ্ধ এবং অদৃশ্য সাইবার আক্রমণ। টুভালুর একজন প্রতিনিধি একটি এআই অ্যাভাটারের সাথে কার্বন ক্রেডিট নিয়ে বিতর্ক করছেন, আর এস্তোনিয়ার ‘ডিজিটাল রাষ্ট্রদূত’ মেটাভার্সে দুর্লভ মৃত্তিকা খনিজের চুক্তি সিল করছেন। এটি কোনও সাই-ফাই স্ক্রিপ্ট নয়—এটাই আগামীকালের কূটনীতি।
যেসব রাষ্ট্র পরিবর্তনের গতি ধরতে পারছে না, তাদের নিষ্ক্রিয়তার মূল্য অস্তিত্বহীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারে: উপকূলের বিলুপ্তি, হ্যাক করা রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য এবং এমন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা যেখানে অ্যালগোরিদম, জিন ও কোয়ান্টাম কোড নিয়ন্ত্রণকারীরাই প্রাধান্য বিস্তার করবে।
ক্ষমতার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এআই ও কোয়ান্টাম সিস্টেমে দক্ষতার মাধ্যমে, যা সতর্ক করেছিলেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াব তার দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলিউশন বইয়ে।
বৈশ্বিক উদ্ভাবকরা কে কী করছে:
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তরে থেকে দক্ষিণে, বহু দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে, কারণ প্রযুক্তির বিভিন্নমুখী ব্যবহারের প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে।
এস্তোনিয়া এখন সাইবার আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য বিদেশি মাটিতে স্থাপিত সার্ভারে স্থাপিত ‘ডিজিটাল দূতাবাসে’ গুরুত্বপূর্ণ ডাটা সংরক্ষণ করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এআই ব্যবহার করে অভিবাসন সংকট ভবিষ্যদ্বাণী করে, আর ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সময় সপ্তাহ থেকে ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছে।
কিউবা, একসময় নিষেধাজ্ঞায় বিচ্ছিন্ন, এখন CRISPR পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন আফ্রিকায় বিক্রি করে সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে।
কেনিয়া খরা-প্রতিরোধী ফসল দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে বিক্রি করে প্রমাণ করছে যে বায়োটেকনোলজি কূটনীতির হাতিয়ার হতে পারে।
এমনকি একসময় গবেষণাগারের সীমাবদ্ধ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এখন কূটনীতির রূপ বদলে দিচ্ছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, চীনের জিউঝাং কোয়ান্টাম কম্পিউটার সম্প্রতি এমন এনক্রিপশন ভেঙেছে যা অজেয় বলে বিবেচিত হতো, যার ফলে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসে শঙ্কা তৈরি করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কূটনৈতিক বার্তা সুরক্ষিত করতে ‘কোয়ান্টাম-সেইফ’ ব্লকচেইনে ৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং আমাদের বর্তমানে ব্যবহৃত সব এনক্রিপশন ভেঙে দেবে’, সতর্ক করে গুগলের সাবেক সিইও এরিক স্মিথ ২০২৩ সালের অ্যাস্পেন সিকিউরিটি ফোরামে বলেছিলেন, ‘সরকারগুলোর এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত’।
অন্যদিকে, ভারত ‘টেকপ্লোমেসি’র পথিকৃৎ হয়ে বৈশ্বিক দক্ষিণ ও পশ্চিমের মধ্যে বিভেদ কমাতে চাইছে। এর ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই)— আধার বায়োমেট্রিক আইডি ও ইউপিআই পেমেন্ট সিস্টেম— আফ্রিকা ও এশিয়ায় রফতানি করা হয়েছে। কিন্তু দিল্লির বড় উদ্যোগ হলো অংশীদারত্ব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সাথে ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজি উদ্যোগ (ICET)-এর লক্ষ্য এআই সংক্রান্ত নিয়ম। কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ও সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খলা যৌথভাবে উন্নয়ন এবং বেইজিংয়ের আধিপত্য মোকাবিলা।
ইইউ’র সাথে ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজি কাউন্সিল (TTC)-এর মাধ্যমে নৈতিক এআই শাসন ও সবুজ প্রযুক্তিতে মনোনিবেশ করে ভারতকে ‘নিয়ম-নির্ধারক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
‘প্রযুক্তিই এখন কূটনীতির নতুন মুদ্রা। ভারতের ভূমিকা হলো নিশ্চিত করা যে এই মুদ্রা যেন কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়’। বলেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ২০২৩ সালের রাইসিনা ডায়ালগে।
বেঁচে থাকার কৌশল: অভিযোজন বা ডুবে যাওয়া
উত্থিত সমুদ্র ও প্রযুক্তিগত বিঘ্নের (Tech disruption) মুখে থাকা দেশগুলোর জন্য বিশেষজ্ঞরা তিনটি জরুরি পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছেন।
১. প্রযুক্তি ও কূটনীতির সমন্বয় সাধন
সংযুক্ত আরব আমিরাতের এআই-চালিত কনস্যুলার পরিষেবা এখন ৮০ শতাংশ রুটিন জিজ্ঞাসা সামলায়। কূটনীতিকদের অন্যান্য কাজে যেমন এআই-চালিত বিভ্রান্তি মোকাবিলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এস্তোনিয়ার ডিজিটাল দূতাবাস ডাটা সার্বভৌমত্বের মডেল, আর রুয়ান্ডার এআই পলিসি ল্যাব নিশ্চিত করে যেন অ্যালগোরিদম পক্ষপাতিত্বকে শক্তিশালী না করে।
সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণন ২০২২ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বলেছিলেন, এআই কূটনীতিকদের প্রতিস্থাপন করবে না, কিন্তু এআই ব্যবহারকারী কূটনীতিকেরা, যারা ব্যবহার করে না তাদের প্রতিস্থাপন করবে।
২. জলবায়ু প্রযুক্তির ব্যবহার
কিউবা ও কেনিয়া বায়োটেকনোলজিকে কূটনৈতিক মুদ্রায় পরিণত করেছে— একটি কৌশল যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উপযোগী। ভিয়েতনামের CRISPR-সম্পাদিত বন্যা-প্রতিরোধী ধান নিম্নাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে, আর ডাচ জল-ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ইতোমধ্যে একটি ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত।
‘জলবায়ু অভিযোজনই কূটনীতির নতুন সীমানা’, বলেছিলেন জাতিসংঘের সাবেক জলবায়ু প্রধান প্যাট্রিসিয়া এস্পিনোসা ২০২১ সালে দ্য গার্ডিয়ান-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।
৩. নতুন জোট গঠন
ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া এখন পশ্চিমা প্রযুক্তি প্রভাবশালী বলয় এড়িয়ে বাহাসা ও মালয় ভাষায় এআই সরঞ্জাম যৌথভাবে উন্নয়ন করছে। ‘ডিজিটাল উপনিবেশবাদ বাস্তব। আমাদের নিজেদের ভাষা ও চাহিদাভিত্তিক বিকল্প গড়ে তুলতে হবে’, যুক্তি দিয়েছিলেন ভারতীয় প্রযুক্তি কূটনীতিক অভিষেক সিং ২০২৩ সালের গ্লোবাল টেক সামিটে।
বিলম্বের মূল্য: একটি ডিস্টোপিয়ান পূর্বাভাস
নিষ্ক্রিয়তার ঝুঁকি ভয়াবহ। বাংলাদেশে কোয়ান্টাম-হ্যাক করা জমির রেকর্ড ২০ মিলিয়ন জলবায়ু শরণার্থীর দাবি মুছে দিতে পারে। কেনিয়ায় বিদেশি কোম্পানিগুলো খরা-প্রতিরোধী সোরগাম বীজ পেটেন্ট করে কৃষকদের বিদেশি কোম্পানির কাছে নির্ভরশীল করে তুলছে। আর স্থানীয় ভাষার এআই ছাড়া জাতিগুলো সাংস্কৃতিক বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ছে। ‘ভাষা একটি সংস্কৃতির আত্মা। যদি আমরা প্রাধান্যবাজ এআই সিস্টেমের কাছে ভাষা হারাই, আমরা নিজেদেরই হারাব’- বলেছিলেন ভাষাবিদ ও ভাষা অধিকার কর্মী ড. টোভ স্কুটনাব-কাঙ্গাস তার যুগান্তকারী বই লিঙ্গুইস্টিক জেনোসাইড ইন এডুকেশন’-এ।
বুলেটের বদলে বাইটস
২১০০ শতকের বড় খেলাটি অস্ত্রে নয়, অ্যালগোরিদম ও জিন নিয়ে লড়াই হবে। বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য পথ পরিষ্কার: প্রযুক্তি-সচেতন কূটনীতিবিদ গড়ে তোলা, জলবায়ু উদ্ভাবন রফতানি, এবং সহ ডুবে যাওয়া রাষ্ট্রগুলোর সাথে একত্রে ন্যায়বিচার দাবি করা।
জেনেভার হলোগ্রাম যখন জ্বলজ্বল করে, তখন একটি সত্য উদ্ভাসিত হয়। এখনই অভিযোজিত হোন, প্রযুক্তিকে গ্রহণ করুন, নতুবা অতীতের স্রোতে হারিয়ে যান।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত, সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।