চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল হিপোক্রেটিক শপথ খ্রিস্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতাব্দীতে আয়নিক গ্রিক ভাষায় লেখা হয়েছিল। এটি কয়েকটি মূল নৈতিক নীতির সমন্বয়ে গঠিত। আর সেই নীতিগুলোর মধ্যে রয়েছে– শিক্ষকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ, এবং চিকিৎসা শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকার; চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগীর কোনও ক্ষতি না করা; রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত করা; নিজ যৌনতার প্রতি সততা; পেশাগত সীমানা মনে চলা; ইথানেশিয়া বা ইচ্ছামৃত্যু এবং গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা; মেন্টরশিপ ও জ্ঞান বিতরণ; পেশাগত সততা; রোগীর ব্যক্তিস্বাধীনতা বা স্বতন্ত্রতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন; ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং পেশাদারিত্ব বজায় রাখা।
হিপোক্রেটিক শপথের নৈতিক নীতিগুলো প্রাচীন গ্রিসের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক শ্রেণিবিভাগ, সামাজিক নীতির গভীরে প্রোথিত ছিল। এগুলো ঐশ্বরিক শ্রদ্ধা, দার্শনিক নীতিশাস্ত্র, সামাজিক কাঠামো এবং চিকিৎসার বিকাশমান পেশাদারিত্ব, চিকিৎসকদের কমিউনিটি, পেশাগত সম্মান বজায় রাখা, নৈতিক সততা ও মূল্যবোধের সাথে সমন্বয়ে চিকিৎসা পেশা চর্চার গুরুত্বারোপ করে।
আমরা দেখতে পাই শপথটি গ্রিক দেবতাদের কাছে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয়। এখানে চিকিৎসা শিক্ষকদের নিজের পিতামাতার সমান সম্মান করার প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়। যা গ্রিক মূল্যবোধ পাইডিয়া (শিক্ষা) এবং গুরু-শিষ্য সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটায়। এই শপথে রোগীদের কল্যাণ সাধনের জন্য চিকিৎসাবিদ্যাকে কাজে লাগানো এবং কোনও ক্ষতি বা অন্যায় করা থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। এটি গ্রিক চিকিৎসা দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। কেননা এখানে পেশাগত ভারসাম্য ও সংযমের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শপথটি চিকিৎসকদের রোগীর তথ্য গোপন রাখতে বলে। যা রোগীর ব্যক্তিগত সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে গ্রিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়। এই শপথটি এমন সময়ে রচিত হয়েছিল যখন একটি সমাজে খ্যাতি এবং সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। শপথটি রোগীদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ করে। চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে পেশাদার সীমানা এবং ক্ষমতা-সম্পর্কের মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা দেয়। এটি রোগীদের যৌন অসদাচরণ এবং শোষণকে নিষেধ করে এবং নৈতিক আচরণের ওপর জোর দেয়। শপথটিতে অস্ত্রোপচার না করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি শল্যবিদদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যা গ্রিকদের বিশেষীকরণের প্রবণতা পেশাদারিত্বের সীমানার স্বীকৃতিকে ইঙ্গিত করে।
শপথটি বলা হয়েছে ‘আমি সমস্ত ইচ্ছাকৃত ভুল কাজ এবং ক্ষতি থেকে বিরত থাকব”। এখানে ‘কোনও ক্ষতি না করা (অ-ক্ষতিকারকতা)’ এবং রোগীদের উপকারের জন্য কাজ করার (উপকারিতা) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে প্রাণঘাতী ওষুধ (ইচ্ছামৃত্যু) প্রয়োগ করা বা গর্ভপাত করার জন্য ওষুধ প্রদানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যা জীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন ঘটায়। এখানে আমরা দেখতে পাই চিকিৎসকরা রোগীর গোপনীয়তা বজায় রাখার শপথ নেন, যা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের প্রতি আস্থা নিশ্চিত করে। শপথটি একজনের শিক্ষকের পুত্র এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাবিদ্যা শেখানোর জন্য আদেশ করে, যা জ্ঞানের প্রসারের ওপর জোর দেয়।
এই শপথের শুরুতেই গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো, অ্যাসক্লেপিয়াস, হাইজিয়া এবং প্যানাসিয়াকে স্মরণ করা হয়েছে। যা গ্রিকদের চিকিৎসাকে একটি ব্যবহারিক ও পবিত্র শিল্প হিসেবে বোঝাকে নির্দেশ করে। এখানে চিকিৎসা সেবায় ধর্মীয় ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার উপস্থিতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যা তৎকালীন গ্রিক সমাজের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের উপস্থিতি ও প্রভাবকে নির্দেশ করে।
এখানে রোগ নিরাময়ের প্রশ্নে বিভিন্ন মন্দিরের (অ্যাসক্লেপিয়নস) পবিত্র ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়েছে। জীবনের পবিত্রতা রক্ষা করা কথা বলা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইচ্ছামৃত্যু ও গর্ভপাতকে। একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাই চিকিৎসা ধর্ম থেকে ক্রমেই অভিজ্ঞতামূলক পর্যবেক্ষণের দিকে সরে যাচ্ছ। এটা আসলে বৃহত্তর পরিসরে গ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন যুক্তিবাদীতার দিকে অগ্রসর হওয়াকে নির্দেশ করে। রোগীর প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ও কোনও রকম ক্ষতি এড়ানো মোটাদাকে গ্রিক দার্শনিক মূলনীতিগুলোকে নির্দেশ করে।
এই শপথে গুরু-শিষ্য সম্পর্কে ও পেশাগত আচরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা আসলে গ্রিক সমাজের স্তরবিন্যাস ও সদাচরণকে নির্দেশ করে। এছাড়া এই শপথমালা পেশাগত নৈতিক বিষয় যুক্তিসিদ্ধ চিন্তার গুরুত্বকে তুলে ধরে। এখানে শিক্ষা গুরুর সন্তানকে বিন্যামূল্যে জ্ঞান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যা এমন একটি গ্রিক সমাজের ছবি আঁকে যা পিতৃতান্ত্রিক, শ্রেণিভিত্তিক কাঠামো এবং যেখানে সমস্ত পেশা বংশ পরম্পরামূলক এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত।
এই শপথে সাম্প্রদায়িক কল্যাণ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। যা নিশ্চিত করে যে চিকিৎসকরা সামাজিক অবস্থান ও বিশ্বাস বজায় রেখেছেন। অন্যদিকে শিক্ষাদানের প্রতিশ্রুতি প্রাচীন পেশাগুলোতে প্রচলিত শিক্ষানবিশ মডেলকে নির্দেশ করে। এসব মডেলে জ্ঞান ঘনিষ্ঠভাবে সুরক্ষিত ছিল। পারিবারিক বংশ পরম্পরা ও গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মাধ্যমে সঞ্চার করা হতো। অস্ত্রোপচার এড়ানো শ্রমের সামাজিক বিভাজনকে প্রতিফলিত করে। যেখানে অস্ত্রোপচার কাজ বিশেষজ্ঞদের কাছে অর্পণ করা হতো। কারিগরদের অনুরূপ, যখন চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় ও ভেষজ প্রতিকারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন।
যুগে যুগে সাধিত পরিবর্তনগুলো
হিপোক্রেটিক মূল শপথটিতে যুগে যুগে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনগুলো আসলে পরিবর্তনশীল চিকিৎসা পদ্ধতি, সামাজিক মূল্যবোধ ও সমকালীন নৈতিক কাঠামোকে নির্দেশ করে। মূল শপথে গ্রিক দেবতা অ্যাপোলো ও অ্যাসক্লেপিয়াসকে স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সংস্করণগুলোতে ধর্মের সাধারণীকরণ বা এসব দেবতাদের নাম সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন– মধ্যযুগ ও রেনেসাঁকালে (৫ম-১৭শ শতাব্দী) যেমন পরিবর্তন আনা হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে: গ্রিক দেবতাদের পরিবর্তে খ্রিষ্টান ধর্মীয় উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যেকোনও মূল্যে জীবন রক্ষার ওপর। এছাড়া চিকিৎসক-সহায়তায় মৃত্যুর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছিল, যা খ্রিষ্টান ধর্মের নীতিকে প্রতিফলিত করে। তবে রোগীর গোপনীয়তা ও ‘ক্ষতি করবেন না’ এর মূল নীতিগুলো বজায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯শ’ শতাব্দীতে এসে চিকিৎসাবিদ্যার শপথগুলোতে ধর্মীয় উপাদানগুলো অপসারণ করা হয়েছিল যাতে ধর্মনিরপেক্ষ চিকিৎসা অনুশীলন প্রতিফলিত হয়।
এছাড়া বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর; চিকিৎসকের দায়িত্বের পরিধি বাড়িয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অস্ত্রোপচার পদ্ধতির সম্পর্কিত ভাষা পরিবর্তন করা হয়েছিল। কেননা এসময় অস্ত্রোপচার আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। এরপর আসে স্বাস্থ্য, চিকিৎসাবিদ্যা ও চিকিৎসা পেশার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল জেনেভার ঘোষণা (১৯৪৮)।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চিকিৎসা নৃশংসতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। জাতি, ধর্ম বা জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্যের স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান যুক্ত করা হয়েছিল। মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা বিষয়ে শক্তিশালী ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল। জোর দেওয়া হয়েছিল চিকিৎসকদের মানবতার প্রতি দায়িত্বের ওপর। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগীর ব্যক্তি অধিকার ও স্বতন্ত্রতার সুরক্ষা নিশ্চিত একটি মূল নীতিরূপে যুক্ত করা হয়েছিল। ২০ শতাব্দীর শেষ ও ২১ শতাব্দীর শুরুতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন ঘোষণা ও শপথমালায় চিকিৎসা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে রোগীর ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রোগীর সেবা-যত্ন-পরিচর্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলো।
মানুষের রোগ, সুস্থতা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে জেনেটিক গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রশ্নে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা যুক্ত করা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসার ওপর। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও প্রবেশাধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মনোযোগ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে সম্পদ বরাদ্দের চ্যালেঞ্জগুলির ওপর।
এছাড়া যুক্ত করা হয়েছে চিকিৎসাসেবাকর্মীদের সাংস্কৃতিক সক্ষমতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি।
হিপোক্রেটিক শপথের মূল নীতিগুলোতে নির্দিষ্ট যেসব পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে– রোগ নিরাময় ও চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় ধর্মের উপস্থিতি, অস্ত্রোপচারের নিষেধাজ্ঞা, গর্ভপাত, ইথানেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যু, রোগীর গোপনীয়তা নিশ্চয়তা, রোগীর ব্যাক্তিস্বাধীনতা, শিক্ষাদানের দায়িত্ব, চিকিৎসার পেশার সীমানা, চিকিৎসক-রোগীর পেশাগত সম্পর্ক ও চিকিৎসা গবেষণায় নৈতিকতা ইত্যাদি।
মূল শপথে অ্যাপোলো এবং অ্যাসক্লেপিয়াসের মতো গ্রিক দেবতাদের আহ্বান করা হয়েছিল। এই উল্লেখগুলো আধুনিক সংস্করণে সাধারণ স্বীকৃতির সাথে প্রতিস্থাপিত হয়েছে বা সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া হয়েছে। শপথটি মূলত অস্ত্রোপচার নিষিদ্ধ করেছিল। যা বিশেষজ্ঞদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আজ অস্ত্রোপচার চিকিৎসা অনুশীলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই এই নিষেধাজ্ঞা আর প্রাসঙ্গিক নয়। অন্যদিকে শপথের গর্ভপাতের অবস্থান সময়ের সাথে সাথে বিতর্কিত হয়েছে। নতুন করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিছু ব্যাখ্যা এটিকে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হিসেবে দেখে। অন্যরা যুক্তি দেয় যে এটি গর্ভবতী নারীর ক্ষতি এড়ানোর ওপর জোর দেয়। আধুনিক সংস্করণগুলো প্রায়ই গর্ভপাতের নির্দিষ্ট উল্লেখ বাদ দেয়, যা এই বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন করে। মূল শপথটি রোগীর ইচ্ছায় প্রাণঘাতী বিষ দেওয়া নিষিদ্ধ করে, যা ইথানেশিয়া বা ইচ্ছামৃত্যুর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তবে রোগীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও শেষ জীবনের যত্নের আলোচনা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে শেষ জীবনের সিদ্ধান্তগুলোর জটিলতাকে স্বীকৃতি দিয়ে নতুন নতুন ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে। অন্যদিকে রোগীর ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নে মূল শপথটির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক। সেখানে রোগীর কল্যাণের প্রশ্নে যেকোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ছিল চিকিৎসকের। তবে আধুনিক শপথগুলোতে তথ্যভিত্তিক সম্মতি ও রোগীর পছন্দের ওপর জোর দেওয়া হয়। অন্যদিক রোগীর গোপনীয়তার প্রশ্নে মূল শপথে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার কথা বলা হয়েছে। আর আধুনিক শপথগুলোতে জনস্বাস্থের প্রশ্নে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান ও আইনগত প্রয়োজনীয়তার জন্য শর্তযুক্ত গোপনীয়তার কথা বলা হয়। মূল শপথে সদ্য পাস করা একজন চিকিৎসকের অন্যতম দায়িত্ব ছিল তার বিনামূল্যে বিদ্যা সঞ্চার করা। এখানে চিকিৎসাবিদ্যা প্রদান ও অর্জনের ক্ষেত্রে মনোযোগটি আবর্তিত হতো পরিবার কিংবা গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ভিত্তিতে।
তবে একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব আরও বেশি। তাকে চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানের বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে গবেষণা করতে হয়। নতুন প্রজন্মের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করতে হয়। মূল শপথটিতে চিকিৎসা একটি সীমানা এঁকে দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে অস্ত্রোপচার করার অধিকার সবার ছিল না। তবে আধুনিক শপথগুলোতে একজনের দক্ষতার ও অনুশীলনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সমস্ত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ চর্চাকে বৈধতা ও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মূল শপথটিতে চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ককে একান্ত ব্যক্তিগত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে আধুনিক চিন্তা অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা একটি দলভিত্তিক প্রচেষ্টা। কাজেই এখানে চিকিৎসা প্রদানের প্রশ্নে আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মূল শপথে আলোচনা করা হয়নি। তবে আধুনিক ভার্সনগুলোতে নৈতিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও হিপোক্রেটিক শপথ
হিপোক্রেটিক শপথে এমন কিছু উপাদান আছে যা এখন সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল বা অপ্রচলিত বলে বিবেচিত হয়। যেমন, পুরুষ-কেন্দ্রিক ভাষা ও অনুমানসমূহ, পরম্পরাগত ক্ষমতা কাঠামো, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশেষাধিকার, পুরনো চিকিৎসা প্রক্রিয়া, পারিবারিক ও সামাজিক অনুমান, পেশাগত সীমাবদ্ধতা ও নৈতিক পরমবাদ। একটু সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই যে এই শপথের ভাষা ও অনুমানসমূহ পুরুষকেন্দ্রিক। এখানে চিকিৎসক ও রোগীদের ক্ষেত্রে কেবল পুরুষ সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে। এর সুর ও স্বর এমন ধারণা দেয় যে, চিকিৎসাবিদ্যা কেবল একজন পুরুষ চিকিৎসক থেকে পুরুষ ছাত্রের কাছে সঞ্চারিত হয়। এই শপথটি প্রাচীন গ্রিক পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর প্রতিফলন ঘটায়। এখানে নারীদের চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। অথচ প্রাচীনকাল থেকেই নারী চিকিৎসক ও পরামর্শদাতা বিদ্যমান। এই শপথটি চিকিৎসা ও রোগ নিরায়ময়ের প্রশ্নে চিকিৎসকদের পরম কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে বিবেচনা করে। আর চিকিৎসাবিদ্যাকে দেখে সামাজের উচ্চশ্রেণি ও প্রভাবশালী লোকজনের সম্পত্তি হিসেবে।
চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের শিক্ষকদের পারিবারিক সদস্য হিসেবে বিবেচনা করতে সেইজন্য একরকম বাধ্য করে। এ সম্পর্কে শিক্ষণ ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের প্রশ্নে এমন এক ক্ষমতা বলয় তৈরি করে যা রোগীকে নিপীড়ন করা ও তাদের কাছ থেকে অনৈতিক গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এই শপথের আরেকটি দিক হলো এখানে চিকিৎসা ও আরোগ্যের প্রশ্নে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।
এখানে ভবিষ্যৎ চিকিৎসকগণ নির্দিষ্ট গ্রিক দেবদেবীদের নামে শপথ নেন। হেলেনিস্টিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সার্বজনীন চিকিৎসা নৈতিকতা হিসেবে আরোপ করা হয়েছে। জীবন, মৃত্যু ও আরোগ্যের মতো ধারণাগুলোর একটি একক সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার কল্পনা করা হয়েছে এই শপথে। এটি বিভিন্ন আরোগ্যপ্রথা বা চিকিৎসা দর্শনকে স্বীকৃতি দেয় না। এখানে সার্জারির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সৃষ্টি করা হয়েছে চিকিৎসার সাথে বিশেষজ্ঞতা গুলোর কঠোর বিভাজন। তাছাড়া এখানে প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কোনও নির্দেশনা নাই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিধান নিয়েও। এই শপথের পারিবারিক ও সামাজিক অনুমানসমূহ হলো: ‘স্বাধীন পুরুষ ও নারীদের’ উল্লেখ করা হয়েছে, যা দাসপ্রথাকে স্বীকার করে।
এছাড়া এখানে রোগ নিরাময়ে প্রচলিত পারিবারিক কাঠামোর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এখানে চিকিৎসা পেশার সীমানা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, এখানে চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে ডাক্তারের একক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে। কেননা চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিভিন্ন পেশা ও বিশেষজ্ঞ লোকজনের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও তার গুরুত্ব নিয়ে কোনও কথা বলা হয়নি। স্বীকৃতি নেই সহযোগী স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের। অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে।
আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির জন্য কোনও বিধান নেই এখানে। এই শপথে চিকিৎসা নৈতিকতায় সাংস্কৃতিক পার্থক্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এখানে এমন অনেক কঠোর বিধানের কথা বলা হয়েছে যা রোগীর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খাটো করতে পারে। জটিল আধুনিক চিকিৎসা পরিস্থিতির জন্য নমনীয়তার অভাব আছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ও চিকিসা ব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টন বা সেবার অ্যাক্সেসের বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়নি।
লেখক: সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)।