X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

জেসাস, আমরা ভালো আছি

গুঞ্জন রহমান
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৩আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৩

আপনার প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান এই মনুষ্যজাতি, ভালো থাকার সপক্ষে অতি অদ্ভূত সক্ষমতা ও অভিযোজন ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল এই পৃথিবীতে। আমাদের পাপমোচনের জন্য আপনি এই ধরিত্রিতে এসে এত দুঃখ, এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা-দুর্ভোগ-লাঞ্ছনা ভোগ না করলেও, এমনকি স্বীয় প্রাণ বিসর্জন না দিলেও আমরা বোধকরি খুব একটা মন্দ থাকতাম না। মন্দ থাকবই বা কী করে? মন্দ থাকার জন্য প্রথমেই ‘মন্দ’ ব্যাপারটি আদতে কী – সেটা তো জানা প্রয়োজন! হায় পরম-পিতা, আপনার অবুঝ সন্তানেরা যে ভালো-মন্দের প্রভেদ করতেই আর মোটে আগ্রহী নয়! ফলে, তাদের এই ‘নিত্য ভালো থাকা’ রোধে সাধ্য কার?

কী অদ্ভূত এক বিশ্বাস নিয়ে আপনি এসেছিলেন এই ধরিত্রির বুকে – সেই দু’হাজার বছরেরও আগে, আপনি বিশ্বাস করেছিলেন পাপের পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত আপনার সন্তানেরা স্বর্গের দ্বার হতে ফিরে যাবে, যদি তাদের জীবদ্দশায় সেই পাপ স্খলনের জন্য আপনি, পরম পিতা, আপনার পিতৃদায় নিয়ে পবিত্র আত্মার সন্ধান না করেন, মঙ্গল জ্যোতি’র শুভ দৃষ্টিতে তাদের অন্তরের কৃষ্ণগহ্বর আলোকিত না করেন, কেশা গ্রাবধি ক্লেদ সাগরে নিমজ্জিত সন্তানদের টেনে তুলতে শ্বেতশুভ্র আস্থার হাত বাড়িয়ে না দেন, মুক্তির পথে তাদের ফিরিয়ে না নেন।

তাই আপনি পবিত্র আত্মার প্রতিনিধি হয়ে জন্ম নিলেন এই ধূলিধূষরিত মর্ত্যে, মেষ পালকের অতি-অনুল্লেখযোগ্য জীবনযাপন করলেন, রোগ-জ্বরাক্রান্ত মানবগোষ্ঠীকে দিলেন চিকিৎসা, সেবা আর আস্থা। পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়লেন মানব-রিপুর সন্ধানে।

আপনি লড়াই করেছেন অসুন্দরের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অশুচি’র বিরুদ্ধে... অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে। অথচ, আপনার প্রধান শত্রু, আপনার সন্তান এই মানবজাতির প্রধান শত্রু যে অবিশ্বাস – তার জলজ্যান্ত নমুনা যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল আপনারই একান্ত অনুসঙ্গীদের মাঝে! আপনি তো সর্বোজ্ঞ, আপনি কি জানতেন না এই ঘৃণ্য সত্য? জানতেন। নিশ্চয়ই জানতেন। জানতেন বলেই না শেষের সেই রাতে, শেষবার পানপাত্র হাতে নিয়ে, বন্ধু-শিষ্য-সহচর পরিবেষ্টিত হয়েও যেন কোণঠাসা বাঘের মতো একাকীত্বের অসহায়তায়, অথচ পর্বৎ-গুহায় ধ্যানমগ্ন ঋষির অবিচলতায় আপনি দেখতে পেয়েছিলেন আপনার আসন্ন পরাজয়, সন্নিকট নির্মম মৃত্যু। তখনও পর্যন্ত সময় কিন্তু ছিল আপনার হাতে। সহস্রাব্দব্যাপী শান্ত জলধির মতো স্থির-কল্প যে সময় আপনারই অপেক্ষায়, তার নিয়ন্ত্রণ তখনও পর্যন্ত তো আপনারই হাতে।

আপনি চাইলেই একান্ত অনুগত সময় আপনাকে নিয়ে চলে যেত সকল অবিশ্বাস আর কৃতঘ্ন ষড়যন্ত্রের ঊর্ধ্বে। কিন্তু আপনি তা চাইবেন কেন? সন্তানের শেষ পাপটুকু স্বীয় শোণিত ধারায় ধুয়ে ফেলে তবেই আপনি স্বর্গে ফিরে যেতে চাইলেন। তাই রয়ে গেলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অনুসারীদের মাঝে একজন অবিশ্বাসীকে সাথে নিয়ে- সমগ্র মানবজাতির পাপের সমান বৃহৎ সেই ক্রুশ বহনের অপেক্ষায়। শেষ পাপ – প্রভূ? আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলেন, আপনাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করাই হবে আপনার সন্তানদের শেষ পাপ? না, সে বড়জোর প্রত্যাশা হতে পারে, বিশ্বাস নয়। যে সন্তানেরা আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা অতীতেই কখনও রাখেনি, তাদের কাছে এই অন্তিম মুহূর্তে বড়জোর প্রত্যাশাই রাখা যায় – তবে এই হোক তোমাদের শেষ পাপ! ... হায় পরম পিতা, আমরা আপনার শেষ প্রত্যাশাটুকুও আমলে নিতে এতটুকু সচেষ্ট হইনি!

কথায় বলে, পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না। দেখুন, আমরা কী নিষ্ঠার সাথে, পরম দায়িত্বজ্ঞান করে সন্তান থেকে সন্তান অবধি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, জাতির পর জাতিব্যাপ্ত করে বিপুল আগ্রহে খনন করে চলেছি পাপ-পঙ্কিলতার মহাসমুদ্র! হায় যীশু! তবে কি শেষ পাপ ভেবে আপনার সেই আত্মত্যাগ বৃথাই গেল? এই ভুল বুঝতে পেরেই কি তবে তৃতীয় রাত্রিতে আপনার ঐতিহাসিক সেই পুনরুত্থান!

তারপরও মোটের ওপর আমরা হয়ত ভালোই আছি। এককালে এই মাটির পৃথিবী ছিল সদাপ্রভূর স্বর্গরাজ্য। আজ আমরা আপনার সেই স্বর্গভূমিকে আমাদের নিজস্ব নিয়মে 'কাস্টমাইজ' করেছি। রাত্রি না এলে দিনের মহিমা কি বোঝা যায়? কালোর বুকেই না সাদার অবয়ব ফোটে। মন্দ যদি না-ই থাকে, ভালোর প্রভেদ বুঝবো কী করে?

আমরা তাই আপনার রেখে যাওয়া পূণ্যময় পৃথিবীতে নিজ দায়িত্বে পাপের বীজ বুনেছি, বুনেই চলেছি। লোভ, ঘৃণা, ক্রোধ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ আর স্বার্থপরতার জল-হাওয়া-সার-কীটনাশক দিয়ে পরম যত্নে প্রতিপালন করছি পাপের বীষবৃক্ষ। ভালো-মন্দ, উচ্চ-নিচ, ন্যায়-অন্যায়, পূণ্য-পাপের ভারসাম্য-রক্ষায় আমরা সদা সচেষ্ট থাকি।

ভারটা সর্বদা সাম্যের দিকে রাখতে পারি না, তেমনটা চেষ্টাও করি না প্রায়শ। কী জানেন, আজকাল মনে যা থাকে, তাকে মুখে আনাটা খুব বড় বোকামি বলে ধরে নেওয়া হয়। সম্পূরক ভাবেই, মুখে আমরা অনর্গল তা-ই বলে থাকি, যা কখনও মনে নিই না। তো, এই কপটতার বহুগামী চর্চায় আমরা বেশ ভালোই একটা মিঠে কড়া-টক-ঝাল-মিষ্টির পৃথিবী দিব্বি বানিয়ে নিয়েছি। আর কী আশ্চর্য, আপনার মহৎ হৃদয়ের ছিটেফোঁটা এখনও যে আমাদের সংকীর্ণ মনের গহীনে রয়ে গেছে, তারই প্রমাণস্বরূপ কিনা কে জানে, আমাদের একান্ত নিজস্ব, সার্বভৌম অধিকারের এই পৃথিবীতে, আমরা কিন্তু আপনাকেও একটা স্থান দিয়ে রেখেছি! আপনি কী সৌভাগ্যবান – আমাদের এই মানবকূলের মহাশক্তিধর ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবর্গ আজও আপনার নাম নেয়! এরা আপনারই নাম নিয়ে “সাগর পেরিয়ে বোমা ফেলে আসে বীরপুরুষের বেশে”!

এদের প্রায় সকল কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় একটি স্তোকবাক্য আউড়ে – ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’।

না ভুল করবেন না, এটা কোনও প্রার্থনা কিংবা প্রতিজ্ঞা নয়। এ হলো নিছকই এক বিবৃতি। কারণ আমরা তো জানিই, আপনাতে বিশ্বাস অর্পন না করলেও আপনার বিশেষ কিছু করার নেই। সেই যে একবার দু’হাজার বছর আগে আপনি অবিশ্বাসীদের পাপ সাথে নিয়ে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরে গেলেন, আবারও কি ফিরে আসবেন এই মর্ত্যে? আবারও মরতে! ... ফলে, আমরা আপনার কষ্ট লাঘবের জন্যই কিনা, আগেভাগে স্বীকার করে নিলাম – আমরা আপনাকে বিশ্বাস করি।

ব্যস, আপনিও খুশি থাকলেন, আমরাও নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আমাদের জাত-ব্যবসা শুরু করেদিলাম... জানেন তো, আমাদের ব্যবসায়ীরা আজকাল বেশ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে – “ইন গড উই ট্রাস্ট, অল আদার পে ক্যাশ”!

তো, প্রভু যীশু – এভাবেই আমরা যুগে যুগে আমাদেরই গড়া অবিশ্বাসের নিগড়ে স্বীয় আত্মাকে বেঁধে রেখে এমন পাপের বেসাতি চালিয়েই যাবো, আপনি চাইলেও কিছু করতে পারবেন না। অতএব, আপনি আমাদের নিয়ে আর ভাববেন না। আমরা এভাবেই ভালো থাকবো।

আমাদের আর অবতারের দরকার নেই, হে পিতা। আমরা আসলে এভাবেই থাকবো। ভালো-মন্দের সংজ্ঞা কী? সে বড়ই আপেক্ষিক প্রশ্ন। সেই তর্কে না গিয়ে স্বীয় বিবেচনাকেই বাস্তব ধরে নিয়ে আমরা আমাদের এই থাকাটাকে ভালোই বলতে চাই। ভালো বললেই তো ভালো থাকা যায়। এই যে ডিসেম্বর মাস চলছে, আপনার জন্মমাস। আমরা সারাটা মাস ধরে ‘ক্রিসমাস ডে’ পালন করছি। চার্চে মোমবাতি জ্বালছি, বাইরে আলোকসজ্জা। ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হচ্ছে, নতুন কাপড়, নতুন জুতো, খেলনা, চকোলেট... এর কোনোটাই কি আপনার উদ্দেশে?

সবই তো আমাদের নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের জন্য, একান্তই আপনাপন ভোজের জন্য। আমরা এভাবেই নিজ নিজ উদোরপূর্তি চালিয়ে যাবো, আর অপেক্ষায় থাকবো, কখন সান্তা ক্লজ আসবেন আর নিরন্ন-বঞ্চিতদের উপহারসামগ্রী দিয়ে যাবেন। আমরা কিন্তু ফিরেও দেখবো না পার্শ্ববর্তী অসহায় মানুষটিকে – ‘ওসব সান্তা বুড়োর কাজ, আমরা কেন তাঁর কাজে দখলদারী করবো? সবার কাজ ওসবার দায়িত্ব ভাগ করা, ইউ নো? উই আর হ্যাপি অ্যান্ড উই আরঅলরাইট – দ্যাটস অল।‘ জানেন তো, আজকের পৃথিবীতে ‘অলরাইট’ থাকার সূত্র কী? ‘ফার্স্ট অব অল, ফরগেট হুইচ রং এন্ড হোয়াট’স রাইট, দ্যাটস দ্য ওয়ে টু বি অলরাইট’।

জেসাস, সত্যি বলছি – আমরা ‘বোধ হয়’ ভালোই আছি!

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লক্ষ্মীপুরে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ ৭ আ.লীগ নেতা কারাগারে
লক্ষ্মীপুরে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ ৭ আ.লীগ নেতা কারাগারে
নেপাল ও বাংলাদেশ কাবাডি টেস্ট সিরিজের ট্রফি উন্মোচন
নেপাল ও বাংলাদেশ কাবাডি টেস্ট সিরিজের ট্রফি উন্মোচন
হাতিরঝিলে যুবদলের কর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার
হাতিরঝিলে যুবদলের কর্মীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার
‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পরও রুশ হামলা চলছে: জেলেনস্কি
‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার পরও রুশ হামলা চলছে: জেলেনস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক