‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি/ আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই!’ .... জনপ্রিয় গানের কথা
প্রথমেই লেখার সারমর্ম ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছি– ‘আমি জনতার কাছ থেকে লিখতে শিখেছি। আমাকে ‘ট্যাগ’ লাগানোর ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। বাংলাদেশের দালালরা চিরজীবী হোক’!
এবার ট্যাগ বিশ্লেষণ। ভয় দেখিয়ে কাবু করার আগের ধাপ ‘শ্রেণিভুক্ত’ করা। এটা ঐতিহ্যগতভাবে ক্ষমতাসীনরা করে থাকে। প্রত্যেক শ্রেণির একটা নাম থাকে। যারা ব্রিটিশ বিরোধিতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই ‘স্বদেশি’ আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ব্রিটিশরা বলতো ‘সন্ত্রাসী’। পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত যারা পাকিস্তানি জান্তার বিরোধিতা করতো তাদের বলা হতো– গাদ্দার, ভারতের চর, দুষ্কৃতকারী বা অনুপ্রবেশকারী। মুক্তিযোদ্ধারা ‘গাদ্দার’ বা ‘ভারতের চর’ হিসেবে প্রতীয়মান ছিলেন পাকিস্তানি ও তার বাংলাদেশি দোসরদের কাছে! শ্রেণিকরণের নামে ট্যাগ বা তকমা লাগানোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে রাজাকার আলবদর শব্দগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যাগ শব্দটাও জনপ্রিয় হয়। বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) সমালোচকদের ট্যাগ দেওয়া হতো ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে। ‘র’-এর এজেন্ট ট্যাগটাও তখন জনপ্রিয় ছিল। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দুই পর্যায়ের আমলে যারা তার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করতো তাদের বলা হতো জামায়াত শিবির বা বিএনপির দোসর। তাদের পাকিস্তানি ভাবধারার মানুষ বলা হতো। জঙ্গি ট্যাগ লাগানোও একটা ফ্যাশন ছিল। শেখ হাসিনাবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানকে জামায়াত শিবির ও জঙ্গিদের ষড়যন্ত্র বলে থাকে আওয়ামী লীগাররা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কোনও কিছু নিয়ে সমালোচনা করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইদানীং বলা হচ্ছে ‘স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দোসর’ বা শেখ হাসিনার দালাল।
আজকের লেখা কিছু প্রশ্ন নিয়ে। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। স্যালুট জানাই ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে এ কারণে যে মন খুলে কথা বলতে পারছি বা মত প্রকাশ করতে পারছি।
এক.
পলায়নের কারণে শেখ হাসিনাকে দেওয়া দুটো উপাধি জনপ্রিয় হয়েছে। প্রথমটা মিসেস লক্ষণ সেন (লক্ষণ সেনের পর তিনিই এভাবে পালালেন)। পরেরটা শেখ হাসিনা বীর (পলায়ন) প্রতীক। এখন লেজুড়সহ প্রশ্ন হচ্ছে–
ক. শেখ হাসিনা পলায়ন না দেশত্যাগ করেছেন? এবার লেজুড়-
খ. কোনও রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তার পদত্যাগপত্র কি ফেসবুকে পাওয়া যেত আগে? শেখ হাসিনা কি পদত্যাগ করেছেন? কখন, কীভাবে এবং কার কাছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেটা ভেসে বেড়াচ্ছে সেটা কি সত্যি পদত্যাগপত্র?
দুই.
শেখ হাসিনা পলায়ন বা দেশত্যাগ করেছেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিমানে। সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তা ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। কতজন এই প্রশ্নটা সামনে এনেছেন? জাতিসংঘ বিবদমান কোনও কোনও দেশে শান্তি আনার স্বার্থে অন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্য নেয়। ভবিষ্যতের ক্ষমতাসীনরাও কি দেশত্যাগ বা পলায়নকালে এমন সাহায্য পাবেন?
তিন.
এবার লেজুড়সহ আরেকটা প্রশ্ন। আপনারা জানেন সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ছিলেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত সাহেব, যাকে পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কোন কারণে এটা করা হয়েছিল?
‘ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া’র হুমকির কারণে নাকি ‘সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ’-এর বুলেট নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণে? বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও কিন্তু হাত ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এবার লেজুড়-
ক. কার নির্দেশে বা কার কার সিদ্ধান্তে তার মন্ত্রণালয় বদল করা হলো?
খ. এটা কি অপমান? তাহলে সাখাওয়াত সাহেব মেনে নিয়েছেন কেন? ক্ষমতার সহযাত্রী হওয়াই আসল?
চার.
এবার এমসিকিউ টাইপ প্রশ্ন। দেশে এখন ক্ষমতার কেন্দ্র কয়টা?
ক. ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও উপদেষ্টা পরিষদ?
খ. জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও সশস্ত্র বাহিনী?
গ. ওয়াকার-ইউনূস?
ঘ. নাকি উপরের কোনোটা নয়?
কেউ কেউ বলতে পারেন- আগে নিয়ন্ত্রণ করতো ভারত, এখন আমেরিকা। কিন্তু এই প্রশ্ন উঠলো কেন? এর উত্তর এমনটা হতে পারে–
ক. বলা হলো সংশোধন সংস্কার কমিটির প্রধান হবেন ড. শাহদীন মালিক। পরে সেখানে ড. আলী রীয়াজ কীভাবে এলেন? কাদের চাপে? উনি সংবিধানকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চেয়েছিলেন বলে?
খ. পাহাড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে পাহাড়িরা মিছিল মিটিং করেছিল। তবু ধৈর্য না ধরে বাঙালিরা কেন সেখানে সংঘর্ষে জড়ালেন? কার নির্দেশে বা উসকানিতে?
ঘটনার পরে কারা এমন করতে পারে এটা ভেবে কেউ কেউ পুরনো ট্যাগই দিচ্ছেন। স্বৈরাচারের দালাল ট্যাগ দেওয়ার দিন সম্ভবত শেষ। এখন বাংলাদেশের দালালদের দিন।
পাঁচ.
শেখ হাসিনা বিরোধী মত দমনের জন্য মামলার খেলা খেলতেন। এই খেলা কি শেষ হয়েছে, নাকি কখনও হবে না?
ক. ড. ইউনূসের আমলে প্রতি মামলাতেই যেন অজ্ঞাতনামা ১০০/২০০ জনকে রাখা হচ্ছে। গত পঁয়তাল্লিশ দিনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কয়টা মামলা দেওয়া হয়েছে? মামলার সংখ্যা কি বিশ্বরেকর্ড করে ফেললো?
খ. শেখ হাসিনার শাসন মাথা নত করে মেনে নিয়েছেন, নয়তো কেউ কেউ রাতের ভোট বা ডামি ভোটের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু সাবেক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন মাশরাফি কিংবা সাকিব আল হাসান, মন্ত্রী দীপু মনি, বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক কিংবা আসাদুজ্জামান নুর কি খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন? নির্দিষ্ট কিংবা বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগে মামলা না দিয়ে এভাবে দেওয়া হচ্ছে কেন?
ছয়.
বাংলাদেশের মানুষ যদি শহীদ আবরার, আবু সাঈদ, ফাইয়াজ বা মুগ্ধর মৃত্যু ভুলে না যায় তাহলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল কিংবা জাহাঙ্গীরনগরের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে যেভাবে মেরে ফেলা হলো সেসব কি ভুলে যাবে? যারা মুক্তির বিপ্লবে উত্তাল ছিল, মুগ্ধ তাদের পানি খাওয়াতে চেয়েছিল। আর চারদিন বয়সী মেয়েকে বাসায় রেখে মৃত্যুর আগে মাসুদ সামান্য পানি পান করতে চেয়েছিল। মহাকাল কি নির্মমতাকে সহ্য করে নাকি এক নির্মমতা আরেক নির্মমতার জন্ম দেয়? আপনি ভুল করেছেন বলে কি আমরা একই ভুল করতে থাকবো? খুনের অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগরের এক সমন্বয়ককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সমন্বয়করা অনেক জায়গায় সভা করতে পারেননি। এমন হচ্ছে কেন?
সাত.
সাগর রুনী হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, কারণ এটা শেখ হাসিনার আমলে হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বহু মানুষকে খুন ও গুম করা হয়েছিল। ছিল আয়নাঘরের অমানবিক টর্চার। প্রশ্ন হচ্ছে আয়নাঘর কোথায়? যদি গণভবন জাদুঘর হতে পারে তাহলে আয়নাঘর কী দোষ করলো? যারা গুম হলো তাদের সম্পর্কে একটা কথাও বলছেন না কেন কেউ? গরিবদের কখনও কেউ ছিল না তাই?
নাকি এসব কাজে যারা জড়িত ছিল, দেশপ্রেমের কথিত রূপকথা দিয়ে তাদের আর কিছু বলা যাবে না? শুধু চাকরি হারানো মেজর জেনারেল জিয়া বা রিয়ার অ্যাডমিরাল সোহায়েলই জেলে থাকবেন?
আট.
ঋণখেলাপি, হাজার কোটি টাকা পাচার ও শেয়ার বাজার তছনছ করার দায়ে সালমান এফ রহমান কিংবা আট ব্যাংককে ভঙ্গুর করে ফেলা, হাজার কোটি টাকা নয়ছয়ের জন্য এস আলম গ্যাংদের কি কোনও শাস্তি হবে শেষমেশ? এক জীবনে এটা দেখে যেতে পারবো, নাকি একদিন তারা বিশাল পরিমাণ টাকা দিয়ে আইনের ফাঁকটা খুঁজে পাবেন?
নয়.
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন– বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। প্রধান বিচারপতি এক রায়ে মন্তব্য করেছেন- ‘দেশ ও জাতির স্বার্থে তাকে (ডেসটিনির রফিকুল আমীন) আরও কিছু দিন ভেতরে (জেলে) থাকা উচিত।’ যদি তাই হয় তাহলে কয়েকটা খুন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দায়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও সুইডেন আসলাম ছাড়া পায় কীভাবে? কোন নৈতিকতায়? নরসিংদী ও বিভিন্ন জেল থেকে জঙ্গিরা পালিয়েছেন। মুক্তি দেওয়া হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম প্রধান মুফতি জসীমকে। আইন আসলে সবার জন্য সমান না। ওয়ান ইলেভেনের কালে গ্রেফতারকৃত সব রাজনৈতিক নেতাদের জেলে রাখা হলেও শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার জন্য আলাদা সাবজেল তৈরি করা হয়েছিল!
দশ.
ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনের সংখ্যা কম নয় এ দেশে। এদের মধ্যে মাজার ভাঙছে কারা? বায়তুল মোকাররমে মারামারি করেছে কোন দুই দল? হেফাজতে ইসলামীর শফী হুজুর শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়েছিলেন। হেফাজতের একাংশের মুমিনুল সাহেব ও জামায়াতে ইসলামী ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকেই সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এগোচ্ছেন। তাহলে সংঘর্ষ থামছে না কেন?
প্রশ্ন আরও আছে। দশটা তুলে ধরলাম। হাজারের বেশি শহীদের রক্তস্নাত বিপ্লবকে বেহাত করার চেষ্টা করছে কারা? অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা ট্যাগ দিয়ে পাশ কাটানো শেষমেশ কাজ করে না। দয়া করে গোয়েন্দা সংস্থার কিংবা অন্ধ সমর্থকদের কথায় কান না দিয়ে সরাসরি মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করুন।
লেখক: রম্যলেখক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।