X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৪ বৈশাখ ১৪৩২

স্বপ্নবাজ তারুণ্যের গ্রাফিতি  

প্রণব মজুমদার
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:২৮আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২১:২৮

যেকোনও নতুন কিছুই অভিনন্দনযোগ্য! বিশ্বের জনগণকে তা প্রাণিত করে। নৈরাজ্যের পৃথিবী কেউ প্রত্যাশা করে না। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও অশান্তি, অনিয়ম ও দুর্নীতিকে ঘৃণা করে। অন্যায়, বঞ্চনা ও দমনের জন্য সাধারণ জনগণের মধ্যে ছিল চাপা ক্ষোভ। তরুণরাই পারে বিশ্বকে নতুন করে বদলে দিতে। বাংলাদেশও পারে। দেশ অসুস্থ রাজনীতির কোপানলে। অশান্তি, অনিয়ম ও দুর্নীতি, অন্যায়, বঞ্চনা ও দমনের পথে দীর্ঘ সময় হাঁটছিল দেশ। শিশু-কিশোর তরুণদের মধ্যেও ছিল দেশের সাম্প্রতিককালের অপ্রীতিকর ঘটনার ক্ষোভ! একসময় তা বিস্ফোরিত হলো তরুণদের বড় দ্রোহে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার্থী তরুণদের কোটাবিরোধী প্রতিবাদ রূপ নিলো গণ-আন্দোলনে।

ছাত্র-জনতার বীরোচিত সাম্প্রতিককালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের শাসকের পতন হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আপামর জনগণের নজিরবিহীন গণজাগরণে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয় শাসককে। বিদায় নেওয়ার আগে ছয় শতাধিক প্রাণ ঝরেছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

দেশের সরকার পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশের তরুণদের গ্রাফিতি। গ্রাফিতি হলো বিনা অনুমতিতে জনগণের অভিমত শিল্পসম্মতভাবে দেয়ালের ওপর দ্রোহে রোষের কথাগুলো তুলে ধরা। গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দেশের রাজধানীকে অন্য এক রূপে দেখা গেলো। স্বপ্নবাজ তারুণ্যে ঢাকা পরিণত হয়েছে গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন আর ক্যালিগ্রাফির নগরীতে। এর আগে কখনোই ঢাকার দেয়াল এত রঙিন রূপে দেখা যায়নি। শুধু নান্দনিকতার বিচারেই নয়, গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনের বক্তব্যে যে প্রতিবাদ ও দ্রোহ ফুটে উঠেছে, তার তাৎপর্য অপরিসীম। তরুণ শিক্ষার্থীদের হাত দিয়ে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ই যেন দেয়ালে দেয়ালে ব্যক্ত। সারা ঢাকা শহরের দেয়াল বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে ছেয়ে গেছে।  

দেয়ালগুলো কী বলছে? গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন স্পষ্টতই প্রমাণ করছে, বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন দেয়ালে বড় করে রঙিন হরফে লেখা ‘এখন দরকার জনতার সরকার’। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে ব্যর্থ; সেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের লাগাতার দৃঢ় প্রতিবাদ ছিল দিনবদলের ডাক। গ্রাফিতির নবসাজে নগরের দেয়ালগুলো। সিদ্ধেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয়ের ঠিক পিছনে। দৃশ্যমান বেইলি রোডমুখী রাজধানীর সার্কিট হাউজ রোডের দুপাশের দেয়ালে লেখা অসংখ্য স্লোগান। ‘নিজ স্থানে সৎ থাকি; দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ি।’

লেখচিত্রের বিষয়গুলো খুবই প্রশংসার! আশাবাদী করে তোলে। সমাজ বদলে প্রত্যয়ী শিক্ষার্থীও দলীয়করণ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি ও সহিংসতাকে ঘৃণা করে। 

নানা বিষয় বৈচিত্র্যে আরও মূর্তমান এই গ্রাফিতি। আন্দোলনরত ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবী মানবতাবাদী মুগ্ধ সেদিন পানি পান করিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে আত্মাহুতি দিয়ে গেছেন। সেদিনের তার আন্তরিক ডাকটি যেন আজও শুনতে পায় মানুষ। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মুগ্ধর সেই ডাক- ‘পানি লাগবে পানি।’ ‘জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে।’ ‘বল বীর চির উন্নত মম শির।’ ‘Let’s create our new Bangladesh’, গ্রাফিতি বা দেয়াল লিখনগুলোর বক্তব্যে মূলত ধরা পড়েছে পরিবর্তনেরই আকাঙ্ক্ষা।

পাশাপাশি আছে তীব্র একনায়কতন্ত্রবিরোধী মনোভাব। আছে স্বাধীনতার অনুভূতি। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করেছি। জনগণ, স্বাধীনতা, সংস্কার, পুনর্গঠন, অসাম্প্রদায়িকতা, বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি, বাকস্বাধীনতা, নিপীড়নমূলক আইনের বিরোধিতা ঘুরে-ফিরে এই বর্গগুলোই ছিল গ্রাফিতিগুলোর প্রধান বিষয়। এর মধ্যে ‘জনগণ’ বর্গটি ভালোভাবে নজরে পড়ে। ‘জনতায় ভরসা’, ‘জনগণই বিকল্প’, ‘ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার চেয়ে গণক্ষমতা বেশি শক্তিশালী’, ‘জনতাই আইন’- এ ধরনের বক্তব্য বিভিন্ন লিখনে দেখা যাচ্ছে। জনগণ আইন একসময় প্রদায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাঙ্কসি একদা বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে যদি লড়াইয়ের কোনও হাতিয়ারই না থাকে, তবে গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র অস্ত্র।’ চট্টগ্রাম শহরের দেয়ালগুলো যেন বাঙ্কসির ভাষায় ‘সেই অস্ত্রে’ শানিত এক রূপ! এক উত্তাল গণ-আন্দোলনের সাক্ষী। কোটা সংস্কার থেকে এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত কয়েক সপ্তাহের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ইতিহাস এই দেয়াল। হত্যা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আশাবাদ ও সংকল্প আছে গ্রাফিতিতে। যখন আক্ষরিক অর্থেই কেউ কথা বলতে পারছিল না, ইন্টারনেট দেশে কিছু দিনের জন্য ‘ব্ল্যাকআউট’ হয়েছে, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে’ ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লোকজনকে, ভয়ভীতির মধ্যে সেই সময় সাহস জুগিয়েছে গ্রাফিতি বা দেয়াল লিখনের এই ক্যানভাস।

আবারও ফিরে আসি ব্যাঙ্কসির কথায়। জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পী বলেছেন, ‘পৃথিবীর দারিদ্র্য দূর করার ক্ষমতা আপনার নেই। কিন্তু যে ছবি আপনি দেয়ালে হাজির করলেন, তা অন্তত প্রস্রাব করতে আসা একজন লোককে হাসাতে পারবে।’ এই কথার তাৎপর্য নিয়ে ভাবতে গেলে অনেক ছবিই মাথায় আসে। গ্রাফিতি যে ক্ষমতাহীন লোকের মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার, তা পরিষ্কার হয়। শিল্পী রাজীব দত্তের ভাষায়, আইন যত কঠোরভাবে ‘সেন্সরশিপ’ দিয়ে মানুষের কণ্ঠরুদ্ধ করেছে, গ্রাফিতি ততই বেড়েছে। তার কাছ থেকে জানা গেলো, ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে দেশে প্রথম গ্রাফিতি লেখেন আইজুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ ঢাকার দেয়াল থেকে গণমানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছিল। দেয়ালে দেয়ালে দাবিনামার সঙ্গে তখন মানুষ আইজুদ্দিনের নাম জুড়ে দিতো। ‘বেকারদের চাকরি দাও’ এমন দাবির পরিশেষে লেখা হলো ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’। শোনা যায়, আইজুদ্দিন রিকশাচালক ছিলেন। তাঁর মনের দুঃখ দেয়ালে বাড়ি খেয়ে এভাবে তা সাধারণ মানুষের কষ্টের ভাষায় পরিণত হলো। অর্থাৎ গ্রাফিতি গণমানুষের মনের কথা হয়ে ওঠে বা মনের কথাই বলে। ২০১৭ সালের দিকে ‘হবে কি’ নাম গ্রাফিতি শিল্পী বা শিল্পীরা জন্ম দিলেন সুবোধ সিরিজের। একটা খাঁচায় বন্দি সূর্য নিয়ে আলুথালু চুলের এক তরুণ পালিয়ে যাচ্ছে কোথাও। স্ট্যানসিলে আঁকা এই ছবির পাশে লেখা হলো, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে’। আবির্ভাবের পরপরই আলোচনায় এসেছিল সুবোধ। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে সেই সময় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়েছিল, ‘সুবোধ কেন পালাচ্ছে’। এরপর সময় যতই প্রতিকূল হয়েছে, সুবোধ হাজির হয়েছে দেয়ালে ও দেয়ালে। ‘সুবোধ কবে ভোর হবে’ এমন প্রশ্নে সবাক হয়েছে ঢাকার দেয়াল।

২০২৪ সালের কোটা আন্দোলনের শুরুর দিকে সরকারের বিপক্ষে কোনও মতামত দেওয়াই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তখন দেয়াল মানে গ্রাফিতিই একমাত্র বলতে লাগলো সরকারের দমন নিপীড়নের কথা। নিপীড়নের সময় স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করেই আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। তাতে শৈল্পিক সুষমার চেয়েও কথা বলার বিষয়টাই প্রাধান্য পেয়েছিল। দেয়ালগুলো গালিগালাজেও ভরে উঠেছিল। তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর দেয়ালগুলো রঙিন আর আশাবাদের কথায় ভরা। যারা কী হয়েছে, কিছুই জানতেন না, যারা দেশে ছিলেন না সেই সময়, তাদের জন্য এই দেয়ালগুলো ছিল অবশ্য উদ্দীপক দ্রষ্টব্য। দেয়ালের দিকে তাকালেই যে কেউ একটা সময়কে বুঝতে পারবেন। লিখিত কোনও ইতিহাসের চেয়েও উদ্দীপ্ত প্রতিবাদী তারুণ্যের গ্রাফিতি কোনও অংশে কম নয়। আশাবাদী তরুণ তরুণীদের ন্যায়ের পথে শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক। আর গ্রাফিতির সেই প্রত্যাশিত সুন্দর কথাগুলো অচিরেই কার্যকর হবে- এমন আশা আমার মতো সাধারণ জনগণেরও।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন
এনসিপি ‘গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি’ গঠন
এনসিপি ‘গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি’ গঠন
৩য় প্রান্তিক শেষে ওয়ালটনের মুনাফা ৬৯৬ কোটি টাকা
৩য় প্রান্তিক শেষে ওয়ালটনের মুনাফা ৬৯৬ কোটি টাকা
এনসিপি আইনজীবী উইংয়ের প্রস্তুতি কমিটি গঠন
এনসিপি আইনজীবী উইংয়ের প্রস্তুতি কমিটি গঠন
সর্বশেষসর্বাধিক