X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগের দোসর এবং ম্যাকারথিজম

শেরিফ আল সায়ার
২৬ আগস্ট ২০২৪, ১৭:১৭আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১৯:১২

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জাহাজে কাজ করা এক যুবককে হঠাৎ চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি বুঝতেই পারছিলেন না, কেন তার চাকরি চলে গেলো। ঠিক কী কারণে তিনি নিরাপত্তার জন্য হুমকি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন লরেন্স পারকার নামের ওই যুবক। শুধু পারকার নয়, তার মতো ৩ হাজার ৮০০ কর্মীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই ছাঁটাইয়ের কাজ অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়। নিজেদের পক্ষে কোনও যুক্তি-তর্কের সুযোগ দেওয়া হয়নি কাউকেই।

তবে দেশের পরিস্থিতি দেখে পারকার ধারণা করছিল- সম্ভবত বামপন্থী মেরিটাইম কুকস অ্যান্ড স্টুয়ার্ডস ইউনিয়নের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থনের কারণে তার চাকরি চলে গেছে। আদালতের দ্বারস্থ হন পারকার। আদালতও নির্দেশ দেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের নথিপত্র যেন পারকারকে দেখানো হয়। নির্দেশটি কাগুজে ছিল। বাস্তবতা হলো, তাকে কোনও ধরনের প্রমাণ দেখায়নি কর্তৃপক্ষ। বিভ্রান্তিকরভাবে প্রমাণ ছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ দমনের বলী হয়েছিলেন পারকার।

পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এটিকে বলা হতো ‘লাল আতঙ্ক’। হাজার হাজার আমেরিকানের ওপর দমন-নিপীড়ন করা হয় শুধু কমিউনিস্ট রাজনীতির সমর্থক হিসেবে সন্দেহ করার অভিযোগে। শুধু তাই নয়, সমর্থন ছাড়াও কেউ যদি কমিউনিস্টদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে তাদেরও একই কায়দায় দমন করা শুরু হয়। বহু লোক চাকরি হারিয়েছিল, জেলে যেতে হয়েছিল। পুরো সমাজে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। আর এর সূচনা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ ম্যাকারথি নামের একজন সিনেটর।

১৯৫০ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার হুইলিং শহরে দেওয়া একটি ভাষণে সিনেটর জোসেফ ম্যাকারথি দাবি করেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টে কমিউনিস্টরা কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে তিনি ২০৫ জনের একটি সংখ্যা উল্লেখ করেন। যদিও পরে এই সংখ্যায় তিনি বিভিন্ন পরিবর্তন আনেন। তার এই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ভয় ও সন্দেহের কারণে সরকারি তদন্তের মাত্রা বেড়ে যায়। এর মধ্যে শুরু হয় উইচ হান্টিং। অর্থাৎ কারও সঙ্গে যদি কারও শত্রুতা থাকে তাহলে সেখানেও ব্যবহার হতে থাকে এই কমিউনিস্ট সম্পৃক্ততার কার্ড।

একাডেমিশিয়ানরা এটিকে নাম দিয়েছিলেন ম্যাকারথিজম। যার মানে হলো, একটি মতাদর্শকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে একঘরে করে দেওয়া। তাদের বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া। সবসময় চাপের মধ্যে রাখা, যেন কোনোভাবে নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন তারা প্রকাশ করতে না পারেন এবং অন্য কেউ যেন এই দর্শন নিয়ে চর্চা করার সাহস না পায়।

বাংলাদেশে এই ম্যাকারথিজম চলেছে দীর্ঘদিন। যদিও প্রবীণ অনেকে বলেন, বাংলাদেশে কখনই বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্র ছিল না। সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাসীনদের হাতে বন্দি ছিল এই স্বাধীনতা। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রটি বরাবরই দুর্বল ছিল।

সর্বশেষ যে সরকার গণ-আন্দোলনের মুখে চলে গেলো, তাদের আমলে ফেসবুকে পর্যন্ত কথা বলা ছিল রীতিমত 'অন্যায়'। একটি দলবাজ নব্য শ্রেণি গড়ে উঠেছিল গত ১০ বছরে। যারা ক্রমাগত সরকারকে নিয়ে ন্যূনতম কোনও সমালোচনা করলে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হতো। এরপর শুরু করতো নানাভাবে হয়রানি। প্রভাবশালী হলে চাকরি খেয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হতো। আমার জানা মতে, অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন শুধু নিজস্ব মতাদর্শ প্রকাশের কারণে। অনেকে তো দেশ ছেড়েও চলে গেছেন। এটি ছিল একটি দিক।

অন্যদিকও আছে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে চলতো দমন-নিপীড়ন। আমরা জানি, শুধু কার্টুন আঁকার অপরাধে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরকে অন্যায়ভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এমনকি সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষ নেওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান ‘টেন মিনিট স্কুল’-এর জন্য বিনিয়োগ প্রস্তাব বাতিল করেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। 

এই যে ম্যাকারথিজম চর্চা, সেটি সত্যিকার অর্থে সবচাইতে বড় ক্ষতি করেছে সমাজের। মানুষকে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। একটি বিভেদের দেয়াল তুলে দেয় এসব চর্চা। শুধু রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা অবস্থানের কারণে একে-অপরের শত্রুতে পরিণত হয়, যা একটি সমাজে শান্তি স্থাপনে বড় বাধা তৈরি করে। কেউ মনে রাখে না মানুষের ভেতর থাকা ক্ষোভকে কখনও প্রশমিত করা যায় না। দমনে সেই ক্ষোভ আরও বাড়ে এবং একসময় বিস্ফোরিত হয়।  

আমরা এটাও দেখেছি- বাংলা একাডেমির বইমেলায় কোন বইয়ে সরকারবিরোধী লেখা আছে সেসব বিবেচনায় নিয়ে প্রকাশনী সংস্থার স্টল পর্যন্ত বাতিল করা হয়। এগুলো চলতো উইচ হান্টিংয়ের মাধ্যমে। একজন প্রকাশক তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল বা দমন করার জন্য বাংলা একাডেমিকে বই দিয়ে আসতো। তাদের জানিয়ে আসতো কোন বইয়ে কী লেখা আছে। শুধু তাই নয়, ফেসবুকে এক প্রকাশকের দেওয়া স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট অন্য প্রকাশক বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়ে আসতো। কোনটা সরকারবিরোধী, কোনটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ইত্যাদি অভিযোগ তুলে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সরকারবিরোধী বানিয়ে একটা শ্রেণি ব্যবসায়িক সুবিধা আদায়েও দমনের চেষ্টা করেছে উইচ হান্টিংয়ের মাধ্যমে। যেগুলোতে অংশ নিয়েছে বাংলা একাডেমির মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।

বাংলা একাডেমির এসব স্টল বরাদ্দ বাতিল করা নিয়ে ২০২৩ সালে একটা লেখার কারণে অনেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। অনেকে জানতে চেয়েছেন, বইটি আমি পড়েছি কিনা? আমার উত্তর 'না' শুনে পাল্টা প্রশ্ন ছিল, না পড়ে সেই বইয়ের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি কেন?

প্রথমত, আমি কোনও বইয়ের পক্ষে দাঁড়াইনি। আমার অবস্থান এ বিষয়ে স্পষ্ট। কার বই পড়বো আর কার বই পড়বো না এটা আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। তাই বলে আমি চাই না কারও লেখাকে বন্ধ করে দিতে, প্রকাশকে বন্ধ করে দিতে। আমি চাই নিজ পছন্দ অনুযায়ী সবাই লেখার সুযোগ পাক। পাঠক কোনটি গ্রহণ করবে, সেটি একমাত্র পাঠক নির্ধারণ করবে। আমার চেতনা, আমার মতাদর্শ কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে আমি নই। মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে সানন্দে, ভালোবেসে। কিন্তু এই যে এত এত বাধা এবং দমনের চেষ্টা করা হলো, তাতে কি কোনও লাভ করতে পারলো নব্য গজিয়ে ওঠা দলবাজ শ্রেণিটি? আমার মনে হয় তাদের এখন আত্মসমালোচনা করা উচিত।

মনে রাখা জরুরি- জোর করে যেমন কাউকে কোনও মতবাদ গেলানো যায় না, ঠিক তেমনি জোর করে কোনও মতবাদকে সমাজ থেকে বিলুপ্ত করা যায় না। আমি মনে করি, দমনে বরং ওই মতাদর্শ শক্তিশালী হতে শুরু করে।  

সরকার পতনের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যম সব জায়গায় সেই পুরনো দমন প্রক্রিয়া চলছে। এবার দমনের শিকার হচ্ছে আওয়ামী লীগ মতাদর্শ। অনেকে চাচ্ছেন এই মতবাদকে কীভাবে শেষ করে দেওয়া যায়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, যে দল ফ্যাসিজম চর্চা করেছে তার রাজনীতি করার অধিকার নেই। এখানে অনেকে ব্যক্তি-সরকার এবং দলকে এক করে ভাবছেন। অনেককেই দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষে দু’চার কথা লিখলেই অন্তর্জালে তাকে আক্রমণ করছেন। তারা হচ্ছে বর্তমানে নিজেদের নব্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত মনে করা একটি শ্রেণি। তারাও পূর্বের মতো একই কায়দায় দমন করতে চাইছে। এমনভাবে ঘৃণা ছাড়াচ্ছেন কিংবা এমনভাবে আক্রমণ করছেন যে অনেক সময় ব্যক্তিগত সম্পর্ক পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। এই শ্রেণি গত ১৪-১৫ বছর নিশ্চুপ ছিলেন। তারা অনেকেই হয়তো মনে করছেন, এবার আওয়ামী মানসিকতা যাদের আছে তাদেরও চুপ থাকতে হবে। কিংবা জবাব দিতে হবে? কেন তারা দীর্ঘ সময় চুপ ছিল? অনেকে বুঝতে চাইছেন না, যে কারণে তিনি চুপ ছিলেন ঠিক একই কারণে অন্য অনেকে চুপ করে থাকতে পারেন।

এরমধ্যে নিজের অভিমতকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও আছে। ধরা যাক, গত ১৪-১৫ বছরে আপনি কখনও সরকারকে কঠিন কোনও প্রশ্ন করতে পারেননি। তাই সম্প্রতি নিজেদের ক্ষমতাশীল মনে করা নব্য শ্রেণির অনেকে ভাবছেন- যেহেতু তখন কোনও প্রশ্ন করেননি, সুতরাং আপনিও আওয়ামী লীগের দোসর এবং অবশ্যই এখন আপনাকে চুপ থাকতে হবে এবং বর্তমান সরকারকে নিয়ে কোনও সমালোচনা করতে পারবেন না।

অর্থাৎ মানুষকে কোনও না কোনও দলের ভাবা আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ চেয়েছে সবাইকে আওয়ামী লীগ হতে হবে। না হতে পারলে তাকে চুপ থাকতে হবে। এবার ঠিক একই প্রক্রিয়ায় একটি শ্রেণি ভাবছেন, সবাইকে তাদের মতাদর্শেরই হতে হবে, তাদের মতো করেই ভাবতে হবে। না হলে চুপ থাকতে হবে। অথবা এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে যত মন্দ কথা বলা যায়, সব বলতে হবে। এছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।

এই যে চুপ করিয়ে রাখার মানসিকতা সেটিও খুব অচিরেই নিপীড়িত শ্রেণির মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করবে। এতে সামনের দিনে দুই পক্ষ একে অপরকে শুধু দমন করে খাঁচায় বন্দি রাখার চেষ্টাই করে যাবে। এর কোনও সুস্থ সমাধান আসবে না।

এই যে ম্যাকারথিজম, এটি যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ এই সন্দেহ বাতিক সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায়। এটি যখন সেনাবাহিনীর দিকে চলে যায় এবং যখন তাদের ওপরও গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়, তখন সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে এই ম্যাকারথিজমকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেওয়া হয়।    

জোসেফ ম্যাকারথি অধ্যায় সেখানেই শেষ। তিনি ইতিহাসে একজন দমনকারী সিনেটর হিসেবে রয়ে গেলেন। যে ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছিলেন। মজার বিষয় হলো- ম্যাকারথি'র কাছে কোনও তথ্যই ছিল না যে, স্টেট ডিপার্টমেন্টে কমিউনিস্টরা আছে। আন্দাজে একটা বক্তব্য ছুড়ে দিয়ে পুরো দেশকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিলেন এই ব্যক্তি। সুতরাং আমরা যতই বিভেদের দেয়াল ভেঙে দিতে চাই না কেন, ম্যাকারথিরা এসে আবারও সেই দেয়াল দাঁড় করাতে চাইবে। তারা চাইবে সমাজে বিভেদ থাকুক। তাই ম্যাকারথিদের ইজমকে আমাদের রুখে দিতে হবে। 

লেখক: হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
চট্টগ্রামে খাল-নালায় ১৫ জনের মৃত্যু, তবু উদাসীন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ
চট্টগ্রামে খাল-নালায় ১৫ জনের মৃত্যু, তবু উদাসীন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৫)
মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি
মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি
সর্বশেষসর্বাধিক