আজ রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর। এর অর্থ এ নয় যে, সাত বছর আগে বাংলাদেশে কোনও রোহিঙ্গা ছিল না। শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে প্রথম রোহিঙ্গারা প্রবেশ করে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গারা আসে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। সর্বশেষ মোটাদাগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। এবং সে সময় প্রায় দুই মাসে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
এমনকি ১৯৭৮ সালের আগেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতো এবং ২০১৭ সালের পরেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আগের রোহিঙ্গা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা মিলে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ লক্ষাধিক। বিগত সাত বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ, যার অর্ধেকের বেশি এসেছে ২০১৭ সালে। তাই, ২০১৭ সালে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীর স্রোতকে আমি “ঢল” হিসাবে শব্দবন্ধ করেছি। (Influx এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আমি “ঢল” শব্দটা প্রথম ব্যবহার করি এবং এরপর থেকে এ শব্দটা অনেকে ব্যবহার করছে)।
ফলে, ২০২৪ সাল হচ্ছে সে রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর পূর্তি। আমি প্রতি বছর আগস্টের ২৫ তারিখ বাংলা ট্রিবিউনের জন্য রোহিঙ্গা ঢলের বছরপূর্তি উপলক্ষে একটি কলাম লিখি এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর বর্ষপূর্তি থেকে সাত বছর পূর্তি পর্যন্ত সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাই। বিগত এক বছরে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো মিডিয়াতে আলোচিত হয়েছে যা রোহিঙ্গাদের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিয়ানামরের রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মির সাথে সেনাবাহিনী সংঘাত এবং বর্ডার পুলিশের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা; বার্মিজ সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাতে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা; রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের অন্তর্কোন্দলে অসংখ্য রোহিঙ্গার মৃত্যু, এবং সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর আরাকান আর্মির নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশে ভেসে আসা রোহিঙ্গা লাশ।
আমরা জানি ২০২৩ সালের অক্টোবরে ত্রি-ব্রাদারহুড এলায়েন্স গঠিত হওয়ার পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা সাড়াশি অভিযান শুরু হয়। এ এলায়েন্সের অন্যতম সংগঠন আরাকান আর্মি রাখাইনে রাজ্যের বার্মিজ সেনাবাহিনীকে একের পর এক আক্রমণ করে পরাজিত করে। বিশেষ করে সীমান্ত চৌকিগুলো প্রায় সব আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়। তখন মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। পরবর্তীতে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এ পালিয়ে আসার ঘটনা এ বার্তা দেয় যে, রাখাইন রাজ্য ক্রমান্বয়ে আরাকান আর্মির দখলে চলে যাচ্ছে।
রাখাইন যদি আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী হবে এটা একটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যে ৫/৬ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে বাস করে তাদের সাথে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত রাখাইনের সম্পর্ক কী হবে এবং বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা একটা বড় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।
কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদেরকে উভয়পক্ষ সম্মুখ লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে আমি পত্রিকান্তরে বিস্তারিত লিখেছি, “জান্তা সরকার কন্সক্রিপশান আইনের মধ্য দিয়ে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে যোগদান করাচ্ছে এবং রেজিস্ট্যান্স গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্মুখ বন্দুকযুদ্ধে তাদের দাঁড় করে দিচ্ছি। ফলে রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের জান্তা সরকার কর্তৃক রীতিমতো জোরপূর্বক ব্যবহৃত হচ্ছে।
অন্যদিকে জান্তা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে আরাকানের একটা বড় অংশ আরাকান আর্মির দখল করার পরে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর নাম করে রোহিঙ্গাদের দলে ভিড়ানোর চেষ্টা করছে আরাকান আর্মি। জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াইয়ে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। জান্তা সরকার বনাম আরাকান আর্মির সম্মুখ লড়াইয়ে উভয়পক্ষে মারা পড়ে বেচারা রোহিঙ্গারা। এ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার শানে নুজুল।”
ভাগ্যের কী নির্মম পরিণতি! এখন সেই আরাকান আর্মিই রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন এবং ফর্টিফাই রাইটস এর প্রতিবেদন অনুযায়ী আরাকান আর্মি রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একধরনের ‘ম্যাসাকার’ ঘটাচ্ছে। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে। কেউ কেউ বলছেন, ২০২৪ সালে পুনরায় ফিরে এসেছে ২০১৭ সাল। তখন রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কিন্তু এবার গণহত্যা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি।
আরাকান আর্মির এ হত্যাযজ্ঞের কিঞ্চিত ট্রেলার আমরা বাংলাদেশেও দেখতে পাচ্ছি। যেমন, আগস্টের ৬ তারিখে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় নৌকা ডুবিতে মারা যায় এবং ভেসে উঠে প্রায় ১০ টি রোহিঙ্গার লাশ। ৭ আগস্টেও নাফ নদীতে ভেসে আসে প্রায় ১২ টি রোহিঙ্গার লাশ যা বাংলাদেশের সংবাদ মিডিয়ার ভাষ্যমতে নৌকা ডুবিতে মারা যায়। এছাড়াও ১০ আগস্টে রোহিঙ্গা বসতিতে ড্রোন হামলা হয়েছে সেখানে অসংখ্যা রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা এটাই প্রতীয়মান করে যে, আরাকানে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। জীবন বাঁচাতে তারা নৌকা করে বাংলাদেশের দিকে আসতে থাকে কিংবা বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কোন দেশের দিকে কিংবা অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ছে এসব হতভাগা রোহিঙ্গারা।
এর বাইরে সারা বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল লেগেই ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের মধ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। অতি সম্প্রতি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয়েছে প্রায় ৫ জন রোহিঙ্গা। আগস্ট ২০২৩ থেকে আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত এক হিসাব অনুযায়ী খুনের সংখ্যা প্রায় ২১ জন। এভাবে সারা বছর ব্যাপী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দ্বন্দ্ব সংঘাত, খুনাখুনি এবং হতাহতের ঘটনা লেগেই ছিল।
গবেষণার কাজে আমাকে নিয়মিতভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে হয়েছে। বলতে গেলে, কিছুটা বিরতিতে প্রায় সারা বছর জুড়ে নানান সময় ক্যাম্পে যেতে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দুইটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো।
এক. বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করার কারণে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ এবং প্রতিবেশ একেবারে উজাড় হয়ে গেছে; এবং গাছপালা কেটে রীতিমত সাবাড় করে দেয়া হয়েছে।– এসব বলে যে বয়ান বাংলাদেশে জারি আছে, এবার দেখলাম বিস্তর বনায়নের ফলে কুতুপালং ক্যাম্পের অনেকটা জুড়ে সুন্দর গাছ-গাছালিতে ভরে গেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সাহায্য সংস্থা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বনায়ন নিয়ে কাজ করছে। ফলে, অনেক ফলজ, বনজ এবং ঔষুধী গাছের চারা রোপণ কর্মসূচিতে রোহিঙ্গারা অংশ নিয়ে বিগত কয়েক বছরে ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় চমৎকার বনায়ন করেছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক বলে আমার মনে হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মধ্য ক্রমান্বয়ে হতাশা বেড়ে যাচ্ছে। কেননা, রাখাইনে যেহেতু এখন একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, সেহেতু প্রত্যাবাসানের স্বপ্ন প্রায় ধুসর হয়ে যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশেও রোহিঙ্গারা এখন আর আগের মতো সেভাবে সমাদৃত নয়। তৃতীয় কোনও দেশে চলে যাওয়ার কোনও সুযোগও নেই। সব মিলিয়ে অনেক রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা তীব্র হতাশা লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে, তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত এবং হাতাশাগ্রস্থ।
পরিশেষে বলবো, এরই মধ্যে বাংলাদেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিক হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। আগের সরকারের আমলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য যে সংলাপ জারি ছিল, সেটা কন্টিনিউ হবে নাকি নতুন কোনও পলিসি নিয়ে নতুন সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুটি ডিল করবে এখনও পরিষ্কার না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে এবার পার হচ্ছে ‘সপ্তম রোহিঙ্গা জেনোসাইড স্মরণ দিবস’। রোহিঙ্গাদের জন্য আগামীতে সুন্দর ও সুদিনের প্রত্যাশায়।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।