X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

সংকট থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়?

শেরিফ আল সায়ার
০২ আগস্ট ২০২৪, ২৩:০২আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১৫:৪৮

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে দেশের পরিস্থিতি এখনও সংকটাপন্ন। ৭৫ বছরের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় এটি সবচেয়ে বড় ধাক্কা। একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বর্ষীয়ান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর এই ঘটনাটিকে ১৯৫২ থেকে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতো জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা কোনোটিই আমার নেই। তবু এটিকে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করার সময় এখনই হয়নি বলে আমি মনে করি। এটি বিবেচনা করার জন্য আরও তাত্ত্বিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যেটি ভবিষ্যতে অবশ্যই হবে। তবে ছাত্র আন্দোলন হিসেবে এটিকে আমি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে তীব্র হিসেবে বিবেচনা করছি।

এখন এই সংকট থেকে আমাদের উত্তরণের উপায়টা কী? প্রথমত মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীতে কখনও কোনও ছাত্র আন্দোলনকে বল প্রয়োগ করে কিংবা ভয় ভীতি দেখিয়ে রুখে দেওয়া যায়নি। বিস্ময়ের বিষয় হলো, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা কিংবা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা না করার ফলে সরকার অস্বস্তিতে পড়েছে দেশে-বিদেশে।

যে ব্যবস্থাগুলো ত্বরিত নেওয়া হলে কিছুটা হলেও স্বস্তি আনা যেতে পারে, সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই।

১. দেশে-বিদেশে যেসব ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়ে গেছে সেগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা খুব প্রয়োজন। অন্তত এমন ৪ থেকে ৫টি ভিডিও আছে, যেখানে স্পষ্ট দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য কীভাবে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সদস্যরা কেন অমানবিকভাবে গুলি চালালো এবং তাদের পরিচয় জনগণের সামনে প্রকাশ করতে পারে। তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এখনই জরুরি। এই উদ্যোগটিকে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

২. শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনাটা খুব জরুরি। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে সরকারের তরফ থেকে। এজন্য শান্তিময় পরিবেশ দরকার। এই মুহূর্তে সারা দেশে যত শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছে, দ্রুত তাদের জামিনের ব্যবস্থা করতে পারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্যে সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে একটি তালিকা চাইতে পারে।  যেখানে তারা জানাবে, উক্ত প্রতিষ্ঠানের কোন কোন শিক্ষার্থী আটক কিংবা গ্রেফতার হয়েছে। সেই অনুযায়ী তাদের জামিনের ব্যবস্থা করে দ্রুত অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দিলে অন্তত অভিভাবকরা স্বস্তি পাবেন। আজই রাজধানীর বিভিন্ন থানার মামলায় গ্রেফতার ৪২ এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে জামিন দিয়েছেন আদালত। এই উদ্যোগটিকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। মামলাও দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা দেখছি শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের রক্ষায় নেমে এসেছেন, অভিভাবকরাও নেমে যেতে পারেন।

৩. যেকোনও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংলাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গায়  শুরু থেকেই সময়ক্ষেপণ করায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়েছিল। আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে এককভাবে জামায়াত-বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কথা বলে বরং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনকে বিষিয়ে তোলা হয়েছে। এখন যে ৬৫ জন সমন্বয়কের কথা বারবার আমরা শুনে আসছি, তাদের সঙ্গে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য বসতে পারেন।

যদিও তারা দুই শতাধিক মানুষকে হত্যার বিচার চাইছেন। শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন। তাই সাধারণ শিক্ষার্থী ও মানুষকে হয়রানি বন্ধ ও গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে  দিতে পারলে অবশ্যই সরকারের সঙ্গে সমন্বয়করা আলোচনায় বসতে কিছুটা নমনীয় হবে নিশ্চিত।

৪. আন্দোলনকে উসকে দেওয়ার জন্য দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বক্তব্য দিয়েছিলেন। যেটি খুব একটি সঠিক কাজ হয়নি বলে অধিকাংশই মনে করছেন। এজন্য দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন। কেউ যদি অতি উৎসাহীর মতো কাজ করে থাকেন তাহলে তাদের দায়িত্বশীল পদ থেকে সরিয়েও দিতে পারে।

আর ছাত্রলীগ কেন এত মারমুখী হলো? এই প্রশ্নটিরও মীমাংসা করা জরুরি। সেটিও তদন্ত করে এর সভাপতিসহ যারা মারমুখী হয়েছিল তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা জরুরি।

৫. ৬ সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে নিরাপত্তার নামে ডিবি হেফাজতে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রাখলেন (যদিও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে)। বেআইনিভাবে কেন এভাবে রাখা হলো সেটির জন্যও তাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

দেশে জামায়াত-শিবির কিংবা সন্ত্রাসীরা যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেই খবর কেন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল না? যদি থাকে তাহলে কেন আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? এই প্রশ্নের উত্তর সদ্য বিদায়ী ডিবি প্রধানের কাছে কি সরকার চাইতে পারে না? দায়িত্বে অবহেলার কারণে দেশে এত বড় সহিংসতার দায় কি তার নেওয়া উচিত নয়?

অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর জের ধরে সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেছিলেন। বাংলাদেশে এই নজির স্থাপন করতে হবে। না হলে নিজের কাজটাকে গুরুত্ব দেওয়ার মনোভাব কখনোই গড়ে উঠবে না।

আর তাছাড়া একজন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বেআইনিভাবে ছাত্রদের তুলে এনে জোর করে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ালেন এবং একইসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করিয়ে ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেন (যে কাজটি তিনি প্রায়ই করেছেন)।  রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে "ভাতের হোটেল"। সরকারি একটি সংস্থার সম্মানহানি করার দায়েও কি তার শাস্তি হওয়া উচিত নয়?

৬. যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেখানে আন্তর্জাতিক তদন্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। এটি পরিস্থিতিকে শান্ত করতে কিছুটা সহায়ক হবে। জাতিসংঘকে স্বাধীনভাবে এই তদন্ত করতে সরকার যে সব ধরনের সহযোগিতা করবে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতেই হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে।

বর্তমানে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি পুলিশ। বরং ছাত্রদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। যেভাবে ব্লকরেইড দিয়ে তারা ছাত্রদের গ্রেফতার করেছে, সেটি নিজ বাহিনীর জন্যই বিপদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাহিনী হিসেবে পুলিশ কেন এভাবে গুলি চালালো, সেই আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা এভাবে গুলি করেছে, কার নির্দেশে করেছে- সেই প্রশ্নের উত্তরও এখন সবাই জানতে চায়। এটিও তদন্তে আনা জরুরি।
 
৭. যে শিক্ষকরা মাঠে আন্দোলন করছেন তাদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বসলেও সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারে। হয়তো অনেকেই এখন আলোচনার টেবিলে আসতে চাইবেন না। তবু সরকার যদি আন্তরিক হয় অবশ্যই তারা আসবেন। এক্ষেত্রে দল-মত নির্বিশেষে বিবেচনা করতে হবে। তাদের কথাগুলো শুনতে তো সমস্যা নেই। তিনি যে দলেরই হোক, যে মনোভাবেরই হোক, যে মতেরই হোক। দেশে স্থিতিশীলতা আনতে গেলে সবাইকে সমান গুরুত্বে দিতে হবে। এখন ঐক্যবদ্ধ থাকার সময়, বিভাজন নীতি মোটেও কাম্য নয়।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সংলাপের প্রস্তাবও দেওয়া যায়।

৮. যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অনেককে সহযোগিতাও করা হয়েছে। এই ঘটনায় প্রতিটি স্বজন হারানোর পরিবারকে সহযোগিতা করতে হবে। তাদের পাশে সরকারকে আরও দ্রুত দাঁড়াতে হবে।

মনে কষ্ট কিংবা ক্ষোভ তারা যে পুষে রাখছে না সে বিষয়ে কি আমরা নিশ্চিত? এই ক্ষোভ প্রশমনে সরকারকে আরও উদার হয়ে তাদের পাশে আক্ষরিক অর্থেই থাকতে হবে।  

৯. দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সমর্থকগোষ্ঠীদের অনেকে ভিন্নমত হলেই তাকে কীভাবে রাজাকার, জামায়াত, শিবির বানানো যায় সেই যুদ্ধে নেমে পড়েন। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সমাজে হিংস্রতা তৈরি হয়। তাদের এমন ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানানো এই সময়ে খুবই দরকার। এই রাজনৈতিক অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে গেছে। এমনকি রাজনৈতিক পরিসরে ভিন্নমতকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা সুন্দর গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। সেই পরিসরটিকে উন্মুক্ত করে দিন।

সরকারের এখন মূল কাজ একটি বৃহৎ প্রজন্মের কাছে আস্থা ও আত্মসম্মান ফিরে পাওয়া। খুব সাধারণ মানুষও দেখছে একটি প্রজন্ম কীভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে কথা বলছে। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল। তাকে কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো, কোথায় ঘাটতি ছিল- সেই আত্মসমালোচনার জায়গাটিও খোলা রাখা দরকার।

২০১৮ সালে দুটি আন্দোলন করে এই প্রজন্ম নিপীড়িত হয়েছে, ২০২৪ সালেও তারা পুনরায় নিপীড়নের শিকার হয়েছে এবং ভয়ংকরভাবে গুলি ছোড়া হয়েছে তাদের বন্ধু, সহপাঠীদের দিকে। রক্ত ঝরেছে অনেক শিক্ষার্থীর। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় তাদের পরিবারের গল্পগুলো আসছে। যা মানুষের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। এই ক্ষোভ এই হতাশা প্রশমিত করতে হলে নমনীয় হওয়া দোষের কিছু নয়।  

আমাদের মনে রাখতে হবে তারা ছাত্র। এরাই ভবিষ্যতে দেশকে এগিয়ে নেবে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলকে সামনে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে এই প্রজন্মই। তাদের ছাড়া বাংলাদেশ ভাবা যাবে না।

তাদের দমন নয়, স্নেহ ভালোবাসায় আগলে রাখার কাজটি বাস্তবে রূপ দেওয়া জরুরি। এই বীভৎসতা দেশের মানুষ দেখতে চায়নি, ভবিষ্যতেও চায় না। প্রকাশ্যভাবে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার সুযোগ তৃতীয়পক্ষ আরও নেবে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গতিও বাড়তে থাকবে।

লেখক: হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিরোপার সুবাস পেতে শুরু করেছে বায়ার্ন
শিরোপার সুবাস পেতে শুরু করেছে বায়ার্ন
প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
বিশ্বায়নের পথে কোমর বেঁধে নেমেছে চীন
বিশ্বায়নের পথে কোমর বেঁধে নেমেছে চীন
চবির অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীকে ফেরত পেতে রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি
চবির অপহৃত ৫ শিক্ষার্থীকে ফেরত পেতে রাস্তায় নামার হুঁশিয়ারি
সর্বশেষসর্বাধিক