X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড: বর্তমান ভবিষ্যৎ এবং অগ্রগতির পথ

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২৪ জুলাই ২০২৪, ১৮:১০আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১৮:১০

১৭ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য একটি সুযোগের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে বোঝায়, যা একটি দেশের জনগণের বয়সের কাঠামোর পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত হয়, বিশেষত যখন কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যা অকর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার অংশের চেয়ে বেশি হয়। বাংলাদেশের জন্য এই সম্ভাবনা দেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটকে পরিবর্তন করতে পারে, উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে।

এই সম্পাদকীয়টিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এবং এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সুপারিশ করা হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ একটি অনুকূল জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সম্মুখীন। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬৫.০৮ শতাংশ কর্মক্ষম বয়সের মানুষ রয়েছে যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বিশাল শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ প্রধান আর্থসামাজিক সূচকগুলোর উন্নতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে। এই উন্নতিগুলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগানোর জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করেছে।

গত এক দশকে বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ছিল ৬-৭ শতাংশ, যার অর্থ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী হয়েছে। রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) শিল্প, যা অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য চালিকাশক্তি, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে।

তাছাড়া, ক্রমবর্ধমান তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র, কৃষি এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাঠানো অর্থ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রেখেছে। তবে, এই ইতিবাচক সূচকগুলো সত্ত্বেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সম্পূর্ণ সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শ্রম বাজারের প্রয়োজনীয় দক্ষতার মধ্যে অসামঞ্জস্য। যদিও দেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষার মান উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং অনেক তরুণ তরুণী উচ্চ বেতনে চাকরি করছে, কিন্তু উৎপাদনশীল কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে। মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার সুযোগও অসম, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে অপুষ্টি এবং সংক্রামক রোগসহ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত  সমস্যাগুলো উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

ফলে পর্যাপ্ত এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে। যদিও আরএমজি খাত অসংখ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে, একক শিল্পের ওপর নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার প্রয়োজন রয়েছে। অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং দুর্নীতি ও দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এই সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

সামনের দিকে তাকালে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আমাদের জন্য একটি সুযোগ প্রদান করেছে, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি সহজতর হবে। যদিও সম্ভাবনা বিশাল, তবে এর জন্য বেশ কয়েকটি মৌলিক ক্ষেত্রে কৌশলগত পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন। বাজারের চাহিদার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সামঞ্জস্য রাখতে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষার ওপর এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে জোর দেওয়া হলে যুবসমাজ প্রাসঙ্গিক দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। একইসঙ্গে তাদের আরও কর্মসংস্থানযোগ্য এবং উদ্ভাবন করতে পারার সক্ষম করে তুলতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, এবং অপুষ্টি ও সংক্রামক রোগের মোকাবিলা একটি স্বাস্থ্যকর, আরও উৎপাদনশীল কর্মশক্তি নিশ্চিত করতে পারে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

আরএমজি খাতের বাইরে কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং পর্যটনে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্যোক্তা এবং ছোট ব্যবসাগুলোকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে গতিশীল এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি তৈরি করা যেতে পারে। পরিবহন, জ্বালানি এবং ডিজিটাল পরিকাঠামোর উন্নতি অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সহায়তা করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করবে। শিল্পের বিকাশের জন্য এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য দক্ষ পরিকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতি হ্রাস করা এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুবিন্যস্ত করা অপরিহার্য। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে, বাংলাদেশকে অবশ্যই নীতিগত সংস্কার, বিনিয়োগ এবং সামাজিক পরিবর্তনের মতো একাধিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গুণমান, অন্তর্ভুক্তি এবং বাজারের প্রাসঙ্গিকতার ওপর দৃষ্টি দিয়ে এমন শিক্ষা সংস্কার বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষতার ব্যবধান কমানো যেতে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর সম্প্রসারণ, বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে এবং প্রচলিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য দেশব্যাপী স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং সবুজ প্রযুক্তির মতো উদীয়মান ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে বৈচিত্র্য প্রচার করা হলে একক শিল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকি হ্রাস পাবে। পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এমন একটি নমনীয় শ্রম বাজার গড়ে তোলার পাশাপাশি শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য শ্রম আইন শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবহন, সংযোগের মতো পরিকাঠামোর উন্নতি হলে বাণিজ্য ও যাতায়াত সহজ হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোতে বিনিয়োগ শিল্প ও পরিবারের জন্য টেকসই এবং নির্ভরযোগ্য শক্তি নিশ্চিত করতে পারে। ইন্টারনেট পরিষেবা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার প্রসার তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র এবং ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। একটি ন্যায্য ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরির জন্য কঠোর দুর্নীতিবিরোধী আইন বাস্তবায়ন এবং সরকারি লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে এবং সহজে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো সুবিন্যস্ত করার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। লিঙ্গ সমতা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। ফলে, নারীদের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনে যুবসমাজের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের জন্য তাদের শক্তি ও আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য একটি অনন্য এবং সময়-সংবেদনশীল সুযোগ তৈরি করেছে। বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা এবং কৌশলগত নীতিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে। তবে, এগিয়ে যাওয়ার পথে সরকার, বেসরকারি ক্ষেত্র এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিকাঠামো এবং প্রশাসনে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে এবং সব নাগরিকের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কেবল একটি সুযোগ নয়, একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি তৈরিতে যুবসমাজের শক্তি ও আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগানোর একটি দায়িত্ব।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
ভবেশ চন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ বিব্রতকর: পুলিশ সুপার
চট্টগ্রামে খাল-নালায় ১৫ জনের মৃত্যু, তবু উদাসীন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ
চট্টগ্রামে খাল-নালায় ১৫ জনের মৃত্যু, তবু উদাসীন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৫)
মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি
মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি
সর্বশেষসর্বাধিক