নিজের কানকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, চোখকেও না। বারবার মনে হচ্ছে আমি ভুল শুনেছি, ভুল দেখেছি। দেশের জন্য চরম অবমাননাকর একটি স্লোগান এভাবে উচ্চারিত হতে পারে না। তাও আবার দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ তরুণ-তরুণীদের মুখে চরম বিতর্কিত একটি স্লোগান প্রকাশ্যে, বীরদর্পে উচ্চারিত হলো।
নিজেকে প্রশ্ন করলাম– ওরা কি বুঝে স্লোগানটি দিয়েছে? যে স্লোগান ছিল ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি’। সেই স্লোগান হয়ে গেলো ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’। এটা তো মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে চরম ধৃষ্টতা প্রদর্শন। যারা এই স্লোগান দিলো তারা কি জানে রাজাকার কারা? কাদের রাজাকার বলা হয়? মহান একাত্তরে রাজাকার বাহিনী এই দেশের মানুষের বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল। রাজাকার, আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একাত্তরে দেশটাকে নরক কুণ্ডে পরিণত করেছিল। তারা এই দেশের বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের অগ্রসর মানুষদের ধরে ধরে হত্যা করেছে। রাজাকার অত্যন্ত ঘৃণ্য শব্দ। অথচ এই দেশের ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের কারও কারও মুখে সদর্পে উচ্চারিত হলো, তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। রাজাকার এক অর্থে ঘাতকের প্রতিভূ। অথচ রাজাকারকে মহান করার চেষ্টারত তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ। কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে তারা। শুরুতে তাদের আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থন দেখেছি। মিছিলের মুখগুলো যেন কত আপন। মেধার পক্ষে কথা বলছে। দেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শতকরা ৫৬ ভাগ কোটা বহাল রয়েছে। এখানেই তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদ। কোটা থাকুক, কিন্তু ৫৬ নয়। যুগের চাহিদা অনুযায়ী কোটার সংস্কার দরকার।
তাদের দাবি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা থাকবে। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি, পুতিও এই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে তা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম একটি দেশ পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা এই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রেও আমাদের উচিত একটু সংবেদনশীল হওয়া। কিন্তু আমরা অনেকে কী করলাম, আন্দোলনের মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে হুটহাট মন্তব্য করলাম। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পা দিয়েছি আমরা। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরির ক্ষেত্রে কোটার অংশ হবে কিনা এ নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কথা উঠতেই পারে। তাই বলে অশোভন মন্তব্য তো কাঙ্ক্ষিত নয়। এখন তো প্রকাশ্যে রাজাকার হিসেবে গর্ব ছড়ানো হচ্ছে। রাজাকার কী তাহলে ‘মহান’ শব্দ হয়ে গেলো? তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের কী হবে? ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দের কী হবে? এখন কি তাহলে প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা শব্দের উচ্চারণ করা যাবে না? যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে রাতের অন্ধকারে শহর কাঁপিয়ে রাজাকার পরিচয়ের স্লোগান তুললেন তারা কি আদৌ জানেন একাত্তরে কী কষ্ট, কতটা লাঞ্ছনা, কতটা রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি? স্বাধীন দেশে রাজাকারের পক্ষেও তরুণ প্রজন্মের স্লোগান শোনা গেলো। এখনও আমি এই ঘটনাকে বাস্তব হিসেবে ধরে নিতে পারছি না? বারবার মনে হচ্ছে আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি অথবা ভুল শুনেছি। যে তরুণেরা, যে তরুণীরা এই আপত্তিকর স্লোগান তুললেন এখন তাদের কি একবারও মনে হচ্ছে না মারাত্মক একটা ভুল করেছেন। একটি স্লোগানের মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমিকে কতটা অপমান করেছেন তারা কি আদৌ বুঝতে পেরেছেন? কোটাবিরোধী আন্দোলন করছেন। এক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। কিন্তু দেশকে তো অপমান করতে পারেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের রেশ ধরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এই স্লোগান দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী ভুল বলেছেন? তবে হ্যাঁ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। তাই বলে এমন বিতর্ক, এমন প্রতিক্রিয়া? ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’। মহান স্বাধীনতার প্রতি এই স্লোগান চরম ধৃষ্টতার শামিল। কখনও কখনও মনে হচ্ছে এই স্লোগান তরুণ প্রজন্মের মনের কথা নয়। কারণ তারা দেশকে অনেক ভালোবাসে। তাহলে কি তৃতীয় কোনও পক্ষ তাদের শিখিয়ে দিয়েছে? নিশ্চয়ই ওই পক্ষের উদ্দেশ্য ভালো নয়।
যারা আমার এই লেখা পড়ছেন তারা একবার ভাবুন তো ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’- এই স্লোগানের মাধ্যমে প্রিয় দেশকে কতটা অপমান করলাম আমরা? দেশ মানে মাতৃভূমি। দেশকে আমরা মায়ের সঙ্গে তুলনা করি। মহান একাত্তরে মাকে যারা অপমান করেছিল, লাঞ্ছিত করেছিল সেই রাজাকার হবার স্লোগান দিচ্ছে তরুণ প্রজন্মের একাংশ। ছি ছি কী লজ্জা...।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ‘রাজাকার’ পরিচয়ের জন্য স্লোগান দিয়েছে তাদের বাবা-মায়েরা কি আদৌ তাদের খোঁজ-খবর রাখেন? বাবা-মায়েদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ মুক্তিযোদ্ধা আছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। সন্তান যখন রাজাকার পরিচয়ের স্লোগান দিচ্ছে তখন কেমন অনুভূতি হয়েছে? সন্তানকে ডেকে নিয়ে কেউ কি বলেছেন কাজটা তুমি ঠিক করোনি। এজন্য তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। কখনও কখনও অভিমানে, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে আমরা এমন কিছু বলি, উচ্চারণ করি, যা বুকের গভীরে আঘাত দেয়।
আশা করি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তা বুঝতে পেরেছেন। ইতোমধ্যে স্লোগানের পরিবর্তন করা হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনে স্লোগান উঠেছে ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। কে কাকে রাজাকার বানালো সেটাই বড় প্রশ্ন।
লেখাটি শেষ করি। তার আগে ছোট্ট একটি ঘটনার কথা বলি। উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম হয়ে চিলমারী অভিমুখী রেলপথে পাঁচপীর নামে একটি রেলস্টেশন আছে। একাত্তর সালে পাক হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের সহায়তায় গ্রাম থেকে স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষদের ধরে এনে রেলস্টেশনের একটি কাঁঠাল গাছে ঝুলিয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর কায়দায় নির্যাতন করার পর হত্যা করতো। স্বাধীনতার পর ওই কাঁঠাল গাছটি মারা যায়। রাজাকাররা ছিল এতটাই নিষ্ঠুর, পাষণ্ড। রাজাকাররা ছিল এই দেশের লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষের হত্যাকারী। অথচ রাজাকার শব্দটিকে সদর্পে স্লোগানে পরিণত করা হলো। ছি ছি। এর চেয়ে লজ্জার, ঘৃণার আর কিছু হতে পারে না।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকে তুই রাজাকার শব্দটি সারা দেশে ব্যাপকভাবে ঘৃণা ছড়িয়েছিল। সেই ঘৃণাটাই এখন প্রয়োজন।
একই সঙ্গে প্রয়োজন কোটা সংস্কার বিষয়ক আন্দোলনের একটি যৌক্তিক সমাধান। আমরা যেন অজান্তে কোনও ভুল না করে বসি। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা কতটা যৌক্তিক সেটাও বড় প্রশ্ন। ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, যারা রাজাকারের পক্ষে স্লোগান দেয় তাদের সঙ্গে কোনও আপস নেই। কথায় যুক্তি আছে। তবে সহিংস আন্দোলন সমাধানের পথ হতে পারে না। সহিংস আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ সুবিধা নেয়। একটা কথা প্রচলিত আছে। একটুখানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে, ভুল করেছে যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে। হ্যাঁ, এটাই সত্য?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।