জনমত, জোট ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। একসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী থাকার জন্য লড়াই করেছে এই দলটি। রাজনীতিতে ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান অযৌক্তিক ভারতবিরোধী বক্তব্য, যা কেবল সম্ভাব্য সমর্থকদেরই অসন্তুষ্ট করেনি, ভোটারদের মধ্যে এর ভাবমূর্তিকেও অবনমিত করেছে।
১৯৭৮ সালে সেনানিবাসে জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দলে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে এই দলটি স্বাধীনতার নেতৃত্ব প্রদানকারী, ধর্মনিরপেক্ষ এবং ভারতপন্থি হিসাবে পরিচিত আওয়ামী লীগের পাল্টা হিসাবে নিজেদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন হয়েছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই দলটির নেতারা আওয়ামী লীগকে বিশৃঙ্খল করার চেষ্টা করেছিল। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের একশ্রেণির জনগণ যারা দেশে ভারতের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, সেই সময় তারা এই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
১৯৮০, ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয় বিএনপি। প্রথমে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এই দলটি ক্ষমতায় এসে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের ওপর জোর দিয়ে সরকার পরিচালনা করেছিল।
সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় গর্বকে ঘিরে রাজনৈতিক গল্প উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ভারতবিরোধী বক্তব্যের ওপর দলের নির্ভরতা দলটিকে আস্তে আস্তে দুর্বল করে দেয়।
২০০৬ সালের পর থেকে বিএনপির ভাগ্য পরিবর্তিত হতে শুরু করে। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অভাব এই পতনের মূল কারণ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি বাস্তববাদী মনোভাব নিয়ে আবির্ভূত হয়, তখন বিএনপির সমর্থনের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
বারবার সংসদীয় নির্বাচন বর্জন, বিশেষ করে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্ব মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়। অনেকে বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অস্বীকৃতি হিসাবে বিবেচনা করে। তাই দলটি ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে।
গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার দলের সিদ্ধান্ত এবং বিদেশি বন্ধুদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দলটিকে রাজনীতির অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর এই দলটি ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের প্রয়াসে জনগণের একটি অংশের ভারতবিরোধী অনুভূতিকে কাজে লাগানোর জন্য ভারত বিরোধিতাকে একটি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এই কৌশলটি একেবারেই অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী এবং একটি প্রধান আঞ্চলিক শক্তি। তাই বাংলাদেশের নিরাপত্তা জন্য ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই রকমভাবে ভারতের সেভেন সিস্টার প্রদেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করে কাজ করে চলেছে। বাণিজ্য, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগের বিষয়ে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে। এই অংশীদারত্বগুলো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে সহায়তা করেছে।
তবে বিএনপির ভারতবিরোধী বক্তব্যে সবসময় এই সুবিধাগুলোকে উপেক্ষা করা হয়। ফলে, এই দলের অবস্থান কখনও কখনও ইতিবাচক বিকল্প বা বিতর্কমূলক নীতির পরিবর্তে ভয়-সৃষ্টিকারী বলে মনে হয়। আন্তসীমান্ত জ্বালানি প্রকল্প এবং নদীর জলবণ্টনসহ বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও উদ্যোগ প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে বিএনপির এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে স্পষ্ট। দলটি প্রায়শই ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে, যার অর্থ এই ধরনের জোট বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে।
এই অযৌক্তিক মনোভাবের কারণে বিএনপির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। প্রথমত, এটি ভোটারদের একটি বড় অংশ যারা ভারতকে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসাবে দেখে তাদের বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বাংলাদেশিরা অতীতের অভিযোগের চেয়ে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রবৃদ্ধির দিকে বেশি মনোনিবেশ করে। প্রচলিত ভারতবিরোধী গল্পের বাইরে যেতে না পারায় আধুনিক সময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ বলে মনে হয় বিএনপিকে।
দ্বিতীয়ত, দলের ভারতবিরোধী অবস্থান সম্ভাব্য বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ককে দুর্বল করে দিয়েছে। দিনের পর দিন আরও বেশি সংযুক্ত হয়ে যাওয়া বিশ্বে প্রতিকূল এবং বিচ্ছিন্ন কৌশলগুলো খুব কমই সফল হয়। ভারত-বিরোধিতা করে বিএনপি শুধু ভারতকেই শত্রু করছে না, অন্যান্য দেশ যারা ভারতকে এই অঞ্চলের একটি প্রধান মিত্র হিসেবে দেখে, তাদেরও নিজেদের বিপক্ষে ঠেলে দিচ্ছে।
রাজনীতিতে আবারও প্রাসঙ্গিক হতে হলে বিএনপিকে কৌশলগতভাবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে। এর অর্থ হলো ভারতবিরোধী বক্তব্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে সরে আসা এবং এর পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রকৃত সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য যুক্তিসঙ্গত নীতিগত সুপারিশের ওপর জোর দেওয়া। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিসহ পুঙ্খানুপুঙ্খ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে দলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনগণের সামনে একটি আকর্ষণীয় বিকল্প তুলে ধরতে হবে।
পূর্ববর্তী সরকারগুলোর শাসন ও দুর্নীতির সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করার কৌশলের ওপর জোর দিয়ে উন্মুক্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের প্রতিজ্ঞা করার মাধ্যমে জনসাধারণের আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। জনসাধারণের চাহিদা মেটাতে সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিকল্প প্রস্তাবনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
ভোটাররা সাধারণত আবেগের চেয়ে তাদের ভাগ্য উন্নয়নের কৌশলের ওপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সন্ত্রাসবাদসহ সাধারণ সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ভারতের সহযোগিতা বাংলাদেশের প্রয়োজন।
পরিশেষে বিএনপির বর্তমান অযৌক্তিক ভারতবিরোধী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দলটিকে আরও বন্ধুহীন করবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে জাতীয়তাবাদী বক্তব্যকে আঁকড়ে থাকার বিএনপির সিদ্ধান্ত দলের পতনকে ত্বরান্বিত করবে।
ফলে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ফিরে আসতে হলে বাংলাদেশি জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে এমন দূরদর্শী মনোভাব নিয়ে বিএনপিকে রাজনীতি করতে হবে। একমাত্র তখনই এই দলটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রভাব ফিরে পাওয়ার আশা করতে পারে।
শুধু ভারতবিরোধিতা তাদের নতুন করে রাজনীতির আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে।
লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।