X
বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
২০ আষাঢ় ১৪৩১

গরু মাফিয়া: এতদিন কোথায় ছিলেন?

আমীন আল রশীদ
০১ জুলাই ২০২৪, ১৬:৩০আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪, ১৬:৩০

একটা অদ্ভুত শিরোনাম করেছে দৈনিক কালবেলা। ‘গরু মাফিয়া’। যাকে নিয়ে এই খবর তিনি সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত-সমালোচিত সাদিক এগ্রোর মালিক শাহ ইমরান হোসেন। খবরে বলা হয়, প্রভাবশালীদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন আর নানা চমকের কারণে বারবার আলোচনায় আসে তার খামার। সেখানে নিজেই ক্রেতাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানান। দেখে-শুনে মনে হয় এই ‘সাদিক এগ্রো’ ঘিরেই যেন পরিচালিত হয় তার সার্বিক কার্যক্রম। কিন্তু এই খামারের আড়ালে দিনে দিনে উত্থান ঘটেছে এক গরু মাফিয়ার। দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে রাজধানী পর্যন্ত তিনি বিস্তার করেছেন গরু চোরাচালানের সিন্ডিকেট।

সাদিক এগ্রো আলোচনায় আসে মূলত চলতি বছরের কোরবানির ঈদের সময় কোটি টাকার গরু এবং ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল ইস্যুতে। যে ছাগলের সঙ্গে ছবি দিয়ে প্রথমে আলোচনায় আসেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। পরে ছাগলকাণ্ডে প্রকাশ্য হয় মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের তথ্য। তার দুই স্ত্রী ও সন্তানদের বিলাসী জীবন। শোনা যাচ্ছে, তারা সবাই দেশ ছেড়েছেন।

এর আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। তিনিও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘এতই অর্থ বানিয়ে ফেললেন যে দেশেই থাকতে পারলেন না, তাতে লাভ কী হলো?’

সবশেষ খবর, ছাগলকাণ্ডের সূত্রপাত যে সাদিক এগ্রোতে, সেখানে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। অভিযোগ, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় নদী ও সরকারি জায়গা দখল করে এই খামার গড়ে তোলা হয়েছিল। গণমাধ্যমের খবর বলছে, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল ভরাট করে ও সরকারি খাস জমির ওপর গড়ে ওঠা বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। অভিযানে রিকশা গ্যারেজ, রাজনৈতিক দলের স্থানীয় কার্যালয়, বাসাবাড়ি ও আলোচিত খামার সাদিক এগ্রোর কিছু অংশ ভাঙা পড়েছে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাদিক এগ্রোর মালিককে ঈদের আগেও আমরা নোটিশ দিয়েছি। অবৈধ স্থাপনা থাকলে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। আমরা ঈদের আগে উচ্ছেদ অভিযান চালাইনি। কারণ এর ফলে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো। আমরা এমনটা চাইনি বলে উচ্ছেদে যাইনি। সেই নোটিশের পরেও দখলদাররা কোনও ব্যবস্থা নেননি।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ২৭ জুন ২০২৪)।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ২০০৮ সালে রাজধানীর উপকণ্ঠ বছিলায় মাত্র কয়েকটি গরু নিয়ে যাত্রা শুরু হয় সাদেক এগ্রোর। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে ব্যবসার। তখন থেকেই প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে শুরু করেন ইমরান। আর সেই সুবাদেই জড়িয়ে পড়েন গরু চোরাচালানের সঙ্গে। অল্প টাকায় ভারত থেকে গরু এনে রাজধানীর বিভিন্ন হাটে বিক্রি করেন। এছাড়া থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আনেন উন্নত জাতের গরু। কিন্তু তিনি আলোচনায় আসেন গত কোরবানির ঈদের অতি উচ্চ দামের পশু বিক্রির কারণে। তিনি কোনও কোনও গরুকে ‘উচ্চবংশীয়’ বলেও অভিহিত করেন—যা দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

গণমাধ্যমের রিপোর্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা সমালোচনার মুখে সাদিক এগ্রোতে অভিযান চালায় সিটি করপোরেশন। প্রশ্ন হলো, এখানে অভিযান চালাতে গণমাধ্যমে রিপোর্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত সিটি করপোরেশনকে অপেক্ষা করতে হলো কেন? নদী ও সরকারি রাস্তা দখল করে যে এই খামার গড়ে তোলা হয়েছে, সেটা কি করপোরেশনের কারও চোখে পড়েনি? রাষ্ট্রের কোনও বাহিনীর চোখে পড়েনি? যদি ছাগলকাণ্ডে এই প্রতিষ্ঠানটি আলোচনায় না আসতো, তাহলে কি এখানে অভিযান চালানো হতো? যদিও সিটি করপোরেশনের তরফে বলা হচ্ছে, এটি তাদের নিয়মিত অভিযানের অংশ। কিন্তু মানুষের পারসেপশন ভিন্ন।

দ্বিতীয়ত, ঢাকঢোল পিটিয়ে এই ধরনের অভিযান চালিয়ে আখেরে কী লাভ হয়, সেই প্রশ্নও আছে। কেননা চোর যদি আগেই টের পেয়ে যায় যে পুলিশ তাকে ধরতে আসছে, তাহলে সে তার বাড়িতে চুরির মালামাল রাখে না। বুদ্ধিমান চোর সব মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নেয়। সাদিক এগ্রোতে অভিযান চালানো হবে—এই খবর রাষ্ট্র হওয়ার পরে যথারীতি খামার থেকে সব পশু সরিয়ে নিয়েছেন এর মালিক। ফলে কোরবানির পরেও সেখানে কী পরিমাণ আমদানি নিষিদ্ধ পশু ছিল, সেটা আর জানার উপায় নেই। তবে এটা ঠিক যে বেহাত হওয়া সরকারি তথা রাষ্ট্রের জমি উদ্ধার করাও প্রয়োজন ছিল।

সাদিক এগ্রো বা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুধু নদী ও সরকারি জায়গা দখল বা আমদানি নিষিদ্ধ পশু আনাই নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে দেশের সৎ ও ছোট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। এসব কথিত এগ্রো খামারির কারণে দেশের গবাদিপশুর বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ঈদুল আজহা বা কোরবানির মতো একটি ধর্মীয় ইবাদতকে এরা বড়লোকের দামি পশু কেনার ফুটানি এবং মাংস খাওয়ার উৎসবে পরিণত করে। কোরবানির যে আসল উদ্দেশ্য, তার সঙ্গে কোটি টাকা দিয়ে কথিত উচ্চবংশীয় পশু বিক্রির কোনও সম্পর্ক নেই।

অস্বীকার করা যাবে না, কোরবানির পশু মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং কোরবানিকে একটা ভোগের উৎসবে পরিণত করতে এসব কথিত এগ্রো ফার্মের ভূমিকা আছে। তার চেয়ে বড় কথা, এরা যে ১৫ লাখ টাকায় ছাগল বিক্রি করে, সেটার প্রকৃত দাম সর্বোচ্চ কত হওয়া উচিত– সে বিষয়ে নজরদারির কোনও ব্যবস্থা নেই। একজন ব্যবসায়ী চাইলেই কি একটা গরু কোটি টাকায় বিক্রি করতে পারেন? ব্যবসা মানে তো যা খুশি করা নয়। ১০০ টাকা দিয়ে একটা পণ্য কিনে আপনি সেটা সর্বোচ্চ কত টাকায় বিক্রি করবেন? ১ লাখ টাকায় নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এসব কে দেখবে?

অভিযোগ আছে, অনেকেই এগ্রো ফার্মের নামে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন নিয়ে হয় মেরে দিয়েছেন, অথবা অন্য কোনও ব্যবসায় কাজে লাগিয়েছেন। কেউ কেউ কালোটাকা সাদা করতেও এই ধরনের খামার গড়ে তোলেন এবং যে দামে পশু আমদানি ও বিক্রি করেন, কাগজে-কলমে তার দাম দেখানো হয় অনেক বেশি। এভাবে তারা তাদের ট্যাক্স ফাইল রেডি করেন। এই ধরনের খামারের জন্য বিদেশ থেকে পশু আমদানির নামে টাকা পাচার হয় কিনা—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয়, তাহলে বুঝতে হবে এই ধরনের খামার শুধু দেশের ছোট খামারি বা ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি করছে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও হুমকি। এমনও অভিযোগ আছে যে কেউ কেউ এই ধরনের ফার্ম তৈরির জন্য অনেক কৃষি জমি ধ্বংস করেছেন। কিন্তু সেখানে না হচ্ছে কৃষি না হচ্ছে গবাদিপশু। সুতরাং এগ্রো ফার্মের নামে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে আসলেই কতজন খামার গড়ে তুলেছেন এবং সেখানে আসলেই কী হচ্ছে; কতজন ঋণ শোধ করেছেন আর কতজন টাকা মেরে দিয়েছেন—সেটিরও অনুসন্ধান প্রয়োজন।

সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরানের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগাযোগ রয়েছে এবং এই খামারে তাদের অনেকের বিনিয়োগ ছিল বা আছে, এমনও শোনা যায়। সেই নামগুলোও প্রকাশ করা দরকার। যারা তার খামার থেকে এরকম কোটি টাকার গরু আর লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনেছেন, তাদের আয়ের উৎস খতিয়ে দেখা দরকার। তারা ঠিকমতো ট্যাক্স দেন কিনা—সেটিও জানা দরকার।

গণমাধ্যমে রিপোর্ট আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে বলে সেখানে অভিযান চালিয়েই যেন ইতি টানা না হয়। এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। সামান্য এক ছাগল যেমন মতিউর রহমানের মতো একজন বিরাট দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন—তেমনি সাদিক এগ্রোর মালিক এবং তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়েও নির্মোহ অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

মোদ্দাকথা, বেনজীর আহমেদ বা মতিউর রহমানদের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণমাধ্যমে রিপোর্ট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার আগে বিষয়গুলো জানা যাচ্ছে না। তাদের মতো আরও যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে থেকে শত বা হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন এবং দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন, তাদের সবার নামই প্রকাশ্যে আসা উচিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স বা শূন্যসহনশীল নীতির যে অঙ্গীকার, সেই অঙ্গীকার শুধু কাগজে-কলমে নয়, বরং মানুষ বাস্তবে দেখতে চায়। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্নীতিবাজরা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন, তাদের নামগুলোও মানুষ জানতে চায়। যে সিস্টেমের ফাঁক দিয়ে তারা বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের কাজ করে যেতে পারলেন, সেই সিস্টেম বন্ধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাস্তবায়ন দরকার। না হলে দুর্নীতিবাজরা শুধু হাজার কোটি টাকা বা একটি দুটি প্রতিষ্ঠানকে নয়, বরং পুরো দেশটাই খেয়ে ফেলবে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাহাড়ে বেড়েছে বসতি, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাড়ে ছয় হাজার পরিবারের বাস
পাহাড়ে বেড়েছে বসতি, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাড়ে ছয় হাজার পরিবারের বাস
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৪ জুলাই, ২০২৪)
রাঙামাটিতে বন্যার পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু, আরেকজন নিখোঁজ
রাঙামাটিতে বন্যার পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু, আরেকজন নিখোঁজ
জমজমাট লড়াই শেষে তাসকিনদের কলম্বোর হার
জমজমাট লড়াই শেষে তাসকিনদের কলম্বোর হার
সর্বশেষসর্বাধিক