X
মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪
১৮ আষাঢ় ১৪৩১

ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
৩০ জুন ২০২৪, ২০:৪৪আপডেট : ৩০ জুন ২০২৪, ২০:৫১

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর “টক অব দ্য টাউন’। চায়ের কাপে ঝড় তোলা এই সফর নিয়ে তাই রাজনৈতিক পরিসর ও জনপরিসর বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে যে আলোচনা হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলে রাজনৈতিক পরিসর ও জনপরিসরকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম পক্ষ, প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের সমর্থকরা এ সফরকে সফল বলছেন। ভারতের সঙ্গে করা প্রায় ১০টি সমঝোতা স্মারককে দেশের জন্য লাভজনক বলে তারা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

দ্বিতীয় পক্ষ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলোর কৌশলে সমালোচনা করছেন। কিন্তু তারা ওই সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের ভাগে লাভের বদলে ক্ষতির ভাগ বেশি পড়েছে বলে দাবি করছেন। তবে এর জন্য তারা ভারতকে নয়, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করছে। এই দলে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী রয়েছে। তাদের ওই কৌশলী ভারতবিরোধিতার কারণ “ক্ষমতার লোভ।” তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ভারতের সমর্থন কামনা করছে। তাদের অনেক নেতাই সমর্থন পেতে বহুবার দিল্লিতে দেন-দরবার করেছেন। তাই তারা ভারতকে কোনোভাবেই চটাতে চায় না। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে করা সমঝোতা স্মারকগুলোর সমালোচনাও রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির জন্য করা দরকার বিধায় তারা ‘শ্যামও রাখি ও কুলও রাখি’ নীতি নিয়েছে।

তৃতীয় পক্ষে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষফোড়া ও প্রপাগান্ডার মাস্টার জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা। গোঁড়াপন্থি অন্য ইসলামি রাজনৈতিক দলের মতো তাদের নেতাকর্মীরাও দাবি করছে, ট্রেন ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতকে ভূখণ্ড দখলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

২২ জুলাই বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রেন ট্রানজিট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ট্রানজিট চালুর পর ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের দর্শনা দিয়ে প্রবেশ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারত প্রবেশ করবে। পরীক্ষামূলকভাবে আগামী মাসেই বাংলাদেশ দিয়ে ভারতের রেল চলবে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা।  

এ বিষয়টি নিয়ে যেখানে ভারত অবাধে যাতায়াত করতে পারবে, পৃথিবীর কোথাও এমন চুক্তির নজির নেই বলে দাবি করেছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)।

তারা পরোক্ষভাবে বলতে চাইছে, বাংলাদেশ অচিরেই ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে। সিকিম ও হায়দারাবাদের মতো ভারত বাংলাদেশকে তাদের দেশভুক্ত করবে। এক্ষেত্রে তারা ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ের অখণ্ড ভারত সম্পর্কিত বক্তব্যকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে তারা বলছেন, নেহরু ডকট্রিন মতে ‘ভারত অবশ্যম্ভাবীভাবে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত হবে সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। ছোট জাতিরাষ্ট্রগুলোর সর্বনাশ ঘটবে। তারা সাংস্কৃতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকবে না।’

যদিও প্রকৃতপক্ষে নেহরুর পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে উপরোক্ত বক্তব্যের মিল আছে খুব সামান্য। বরং নেহরু তার ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে যে কথা বলেছেন তার সুর ভিন্ন। তার ভাষায়: ‘Unity is always better than disunity, but an enforced unity is a sham and dangerous affair, full of explosive possibilities. Unity must be of the mind and heart, a sense of the belonging together and of facing together those who attack it.’

এ কথা ঠিক যে নেহরু ডকট্রিনে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগে জিন্নাহর চেয়ে নেহরুর দায়টা বেশি ছিল। আর নেহরু ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের উপর্যুক্ত বক্তব্য মতে, তিনি জোরপূর্বক ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেননি। তিনি জোর করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তিনি তার বইয়ে জোরপূর্বক ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে লজ্জাজনক ও বিপজ্জনক কাজ বলে অভিহিত করেছেন। তার দৃষ্টিতে ঐক্য হতে হবে ‘মন ও হৃদয়ের।’

আর নেহরুর পররাষ্ট্রনীতি খুঁজতে হবে নেহরু ডকট্রিনে নয়, বরং তার ‘পঞ্চশীল নীতি’তে। ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল ভারত গণচীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তার ওই পঞ্চশীল নীতি দৃশ্যমান হয়। ওই পঞ্চশীল নীতির মূল কথা হচ্ছে: ১) একে অপরের ভূখণ্ডের প্রতি অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমিকতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা; ২) আগ্রাসী নীতি অনুসরণ না করা; ৩) সাম্য ও পারস্পরিক উপকার সাধন করা; ৪) একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা; ৫) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারত অধিকাংশ সময়ে তাদের বাংলাদেশ নীতির ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত পঞ্চশীল নীতি অনুসরণ করেছে। অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সহযোগিতা করলেও, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিলেও স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবসময় কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক সুখকর ছিল না। বাংলাদেশের সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতে মধ্যে সীমান্ত সংঘাত প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।

ইউরোপের অন্যতম রূপবতী শহর বুদাপেস্টে অবস্থিত সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আমার দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রির অংশ হিসেবে ‘ইসলামাইজেশন ইন বাংলাদেশ: ইসলামাইজেশন ইনসাইড বাংলাদেশ মিলিটারি’ বিষয়ে এমএ থিসিস লেখার সময়ে সামরিক শাসনামলের ডকুমেন্টস ও পত্রপত্রিকা অনুসন্ধান করতে গিয়ে তৎকালীন সময়ে সীমান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান থাকার তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। কিন্তু ওই যুদ্ধাবস্থায়ও ভারতের সেনারা বাংলাদেশ দখলের তৎপরতা চালিয়েছে এমনটি মনে হয়নি। বরং ওই সংঘাত সীমান্ত সংঘাত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ভারত বাংলাদেশ দখল করে নেবে বলে যে প্রচার-প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াচ্ছে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

ভারত বাংলাদেশের ওপর ‘বড় ভাই-সুলভ প্রভাব’ রাখতে চায়, ‘দাদাগিরি’ ফলাতে চায় এ কথা ঠিক। কিন্তু তারা বাংলাদেশকে অচিরেই তাদের দেশভুক্ত করবে এমন সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ সিকিম বা হায়দারাবাদের পরিণতি ভোগ করবে বলে যে প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।

সিকিম ও হায়দারাবাদের ভারতভুক্ত করার প্রেক্ষাপট ও সময়কালের যুগ বহু আগে পেরিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা থাকলেও নতুন কোনও অঞ্চলের ভারতভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের কূটনৈতিক শক্তি ও সামরিক শক্তি পর্যালোচনা করে ভারত সিকিম ও হায়দারাবাদের মতো বাংলাদেশ দখল করতে চাইবে, ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এতটা অপরিপক্ব, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। গ্লোবাল সুপার পাওয়ার হতে চাওয়া ভারত বাংলাদেশ দখলে সামরিক শক্তি প্রয়োগের বোকামি করবে বলে মনে হয় না।

ভারত যদি সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে তার ভূখণ্ডভুক্ত করতে চাইতো তবে তারা তা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় করতে পারতো। পাকিস্তানি সামরিক সরকার ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তকে অরক্ষিত রেখেছিল। কিন্তু ভারত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান দখল করে ভারতভুক্ত করেনি।

স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে বিনা বাক্যব্যয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তাদের সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করেছে। সুতরাং ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বলছে, ভারতের কখনোই বাংলাদেশ দখল করে তাদের দেশভুক্ত করার ইচ্ছে ছিল না।

বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যুগে ভারতের বাংলাদেশ দখল করে তার দেশভুক্ত করার প্রচারণা জামায়াত-শিবিরের প্রপাগান্ডা ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। জনপরিসরের ওই প্রচারণায় আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

তবে এ কথা ঠিক যে ভারতের সামরিক নীতি সবসময় তার পররাষ্ট্রনীতির ছায়া হয়ে ওঠেনি। কারণ ভারতের সামরিক বাহিনী কৌটিল্যর দর্শন অনুসরণে ‘অর্থডক্স অফেনসিভ ডকট্রিন’ মেনে চলে। উপর্যুক্ত কথা যে ভারতের সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে শুধু প্রযোজ্য তা নয়, পৃথিবীর সব দেশের সামরিক বাহিনীর নিজস্ব সমরদর্শন থাকে। ওই দর্শনে ‘অর্থডক্স অফেনসিভ ডকট্রিনের’ প্রতিফলন স্পষ্ট। আর ওই সমরদর্শন অনুযায়ী তারা সবসময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যুদ্ধ-প্রস্তুতি বলবৎ রাখে। কিন্তু ভারতের সামরিক বাহিনীর ওই ‘অর্থডক্স অফেনসিভ ডকট্রিন’ নিয়ে বাংলাদেশের খুব বেশি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ ভারতের প্রধান সামরিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ নয়। চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী ভারতের রয়েছে। চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবিলায় ভারতের সামরিক বাহিনীকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। তাই বাংলাদেশকে তারা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে একই দাঁড়িপাল্লায় মাপবে না তা বলা যায়। বরং বাংলাদেশ ও তার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে একটি সীমান্ত নিয়ে তাদের বাড়তি চিন্তা করা লাগবে না। তারা তখন পাকিস্তান ও চীন সীমান্তে অধিক মনোযোগী হতে পারবে।

চীনের একের পর এক ভারতের ভূমি দাবি করার অভিযোগ আছে। বিবিসি বাংলায় ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়– চীনের সরকার তাদের দেশের নতুন মানচিত্রে ভারতের সমগ্র অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে দেখিয়েছে। যা নিয়ে ওই সময় বেইজিং ও দিল্লির মধ্যে নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হয়। ফলে ভারতের সামরিক বাহিনীকে তার পুরো মনোযোগ চীন-ভারত সীমান্তে নিযুক্ত করতে হচ্ছে। আর ওই কারণে তারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে চাইছে।

সত্যিকারভাবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভারতে সামরিক বাহিনীর সুসম্পর্ক স্থাপিত হলে শুধু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নয়, সেভেন সিস্টার্স নিয়ে তাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক বাহিনীর সুসম্পর্ক সেভেন সিস্টার্সকে বাইরের প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখবে এমন চিন্তা হয়তো ভারতের সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কাজ করছে বলেই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে নানা সামরিক সহযোগিতায় যুক্ত হতে চাইছে।

উপর্যুক্ত কারণে সাম্প্রতিক দশকে ভারতের সামরিক বাহিনী তাদের বাংলাদেশ নীতির পরিবর্তন করেছে। তাই ভারতের সঙ্গে সামরিক ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সামরিক বাহিনীর উদারনীতির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ডিফেন্স লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) বাস্তবায়নে কিছুটা অগ্রগতি হওয়ায় বাংলাদেশ ভারতকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের তালিকা দিয়েছে বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। ভারতের সরকারি একটি সূত্র দ্য হিন্দুকে বলেছে, ‘২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ নিজেদের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করছে। নতুন অস্ত্র যোগ করছে ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে। এসব প্রয়োজনীয়তার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণের সক্ষমতা রয়েছে ভারতের, যা প্রতিবেশী ২ দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকেও বাড়িয়ে তুলবে।’

এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।

এবার প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে ভারতের নরেন্দ্র মোদি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরালো করতে, সামরিক (সরঞ্জাম) উৎপাদন থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর আধুনিকায়ন নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমরা সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ মোকাবিলায় সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিষয়েও আমরা একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বিমসটেকসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবো’ (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২২ জুন, ২০২৪)।

বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে অস্ত্র কিংবা সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন করতে পারলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ভবিষ্যতে নিজেরাই অস্ত্র উৎপাদন করার প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

সামরিক ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও অবশ্যই ভারত থেকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর অস্ত্র ক্রয়ের পক্ষে নই।

শান্তিকালীন সময়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে অস্ত্র উৎপাদন করলে আমাদের সক্ষমতাও বাড়বে।

সীমান্ত নিয়ে সাধারণত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ হয়। বাংলাদেশ ও ভারত শান্তিপূর্ণভাবে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। তবু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে সবসময় তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ-প্রস্তুতিতে থাকতে হবে, সামরিক নীতি এমনই।

সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের শত্রু প্রায় একই। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের একটি এলাকা নিয়ে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতার কথা বলেছেন। যদি সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক কোনও সুপার পাওয়ার ওই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতা চলায় তবে তার ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতও তার ভূখণ্ড হারাবে। প্রস্তাবিত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের সীমারেখা হবে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ভারতের মিজোরামে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তাই ওই নতুন রাষ্ট্র গঠনের তৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পক্ষে একা রোধ করা সম্ভব হবে না। এ জন্য ভারতের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা দরকার হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক বাহিনী যৌথভাবে কাজ করলেই কেবল ওই খ্রিষ্টান রাষ্ট্র গড়ার তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্রই ইসলামি সন্ত্রাসবাদ বিকাশের ঝুঁকিতে আছে। আইএসসহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো হিন্দুস্তানে যে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে তৎপরতা চালাচ্ছে, তা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও ভারতে সামরিক বাহিনীর একত্রে কাজ করা সময়ের দাবি।

ভারতের বাংলাদেশের প্রতি সামরিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার অন্যতম কারণ চীন ও আমেরিকার বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি যেমন ভারতের অপছন্দ, তেমনি তারা বাংলাদেশে আমেরিকার উপস্থিতিও চায় না। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও আমেরিকার উভয়ের সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিরোধী। এম বি আই মুনসি তার ‘ইন্ডিয়ান ডকট্রিন (১৯৪৭-২০০৭)’ গ্রন্থে দাবি করেছেন:  “The Forward Policy played an important role in India’s strong opposition to a military pact between the United States and Bangladesh during the BJP administration and is being invoked over the recent suspicions concerning Bangladesh’s growing relations with China.” মুনসির উপর্যুক্ত বক্তব্য থেকে ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে অধিক মনোযোগী ও গুরুত্ব দেওয়ার কারণ বোঝা যায়। অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে এখন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশে চীন ও আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি বন্ধ করা। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে চীন ও আমেরিকা থেকে দূরে রাখা। তাই ভারতের বাংলাদেশের প্রতি সামরিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার বিষয়টিকে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা অথবা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখল করার চিন্তার গৎবাঁধা ফ্রেম থেকে বের হয়ে এসে চিন্তা করা দরকার। বাংলাদেশে চীন ও আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি বন্ধ করা ভারতের প্রধান লক্ষ। কারণ উভয় রাষ্ট্রই ভারতের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস নিলে ভারতের অখণ্ডতা ঝুঁকিতে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক লড়াই চীন ও আমেরিকা বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও এক জায়গায় উভয়ের মিল আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা এবং চীনের সেভেন সিস্টার্সে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তৎপরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত। বিপন্ন হবে ভারতের অখণ্ডতা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও খুব বেশি লাভবান হবে না। কারণ চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সফল হলে অথবা আমেরিকার সহযোগিতায় খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রেরণা পাবে, যা বাংলাদেশের অখণ্ডতাকে বিপন্ন করবে। বাংলাদেশের একার পক্ষে পরাশক্তির ওই অপতৎপরতা বন্ধ করা কঠিন।

তাই সামরিক ক্ষেত্রে ভারত সরকারের সহযোগিতার প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করলেই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। সামরিক প্রশিক্ষণ, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায় তথ্যবিনিময় ও সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সরঞ্জাম উৎপাদনের যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছে তা গ্রহণ করলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী আরও শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের অখণ্ডতা বজায় থাকবে। দুর্বল হবে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। পরাশক্তির পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রিটিশ নির্বাচন: উচ্ছ্বসিত প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া অভিবাসীরা
ব্রিটিশ নির্বাচন: উচ্ছ্বসিত প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া অভিবাসীরা
কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ
কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ
সুপ্রিম কোর্টের সাংবাদিকদের আইন বিষয়ে দক্ষ হতে হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
সুপ্রিম কোর্টের সাংবাদিকদের আইন বিষয়ে দক্ষ হতে হবে: অ্যাটর্নি জেনারেল
সৌদি আরবে দূতাবাসের সেবার মান বাড়াতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা
সৌদি আরবে দূতাবাসের সেবার মান বাড়াতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা
সর্বশেষসর্বাধিক