X
মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪
১৮ আষাঢ় ১৪৩১

মধুসূদন দত্ত: আধুনিক বাঙালি মনের রূপকার তবু উপেক্ষিত রয়ে গেলেন কেন?

আনিসুর রহমান
২৮ জুন ২০২৪, ১৬:৫১আপডেট : ২৮ জুন ২০২৪, ১৬:৫১

এই দিনে, আজ থেকে ১৫০ বছর আগে দুনিয়া থেকে তিনি বিদায় নিলেন। তিনি এই জগতে, আমাদের ভুবঙ্গে জন্মেছিলেন ২০০ বছর আগে ঊনবিংশ শতকে। একই শতকে জগতের নানা প্রান্তে উল্লেখযোগ্য কতিপয় প্রতিভা যুগান্তকারী নাম হিসেবে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার লেখালেখি পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাদের মধ্যে নরওয়ের  হেনরিক ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬), সুইডেনের অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ (১৮৪৯-১৯১২), দিনেমার দেশের সৌরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫), হান্স ক্রিস্টিয়ান আন্ডারসন (১৮০৫-১৮৭৫), জার্মানির ইউহান উল্ফগং গ্যেটে (১৭৪৯-১৮৩২), ফরাসি দেশের চার্লস বদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭), রাশিয়ার আন্তন চেখভ (১৮৬০-১৯০৪)), ফিউদর দস্তয়ভস্কি (১৮২১-১৮৮১), লিও তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) এরকম নামগুলো উল্লেখ করা যায়।

ওই সময়ে আমাদের জন্মভূমিতেও আবির্ভাব হয়েছিল বেশ কিছু প্রতিভা, যাদের আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক আত্মপরিচিতির পক্ষে তুলে ধরতে পারি। এদের মধ্যে লালন ফকির (১৭৭২-১৮৯০), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভের সুবাদে দেশে দেশে পরিচিতি লাভ করেছেন, গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, অনূদিত এবং পঠিত হয়েছেন। লালন দর্শন এবং গানও পশ্চিমের কিছু জায়গায়, বিশেষ করে জার্মানি, ফরাসি দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনোযোগ লাভ করেছে। এর বিপরীতে মধুসূদন অনেকটাই উপেক্ষিত এবং অপরিচিত রয়ে গেছেন।

যদিও মার্কিন অনুবাদক, শিক্ষাবিদ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপক ক্লিনটন বুথ সিলি মধুসূদনের ’মেঘনাদবধ কাব্য’ হায়াৎ মামুদের সহযোগিতায় ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।

এর বাইরে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় মধুসূদনের মতো একজন বিরল প্রতিভা এবং বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার স্থপতি অজানা রয়ে গেলেন তাঁর মৃত্যুর ১৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও। এর মধ্যে তার পিতৃভূমির মানচিত্র উল্টেপাল্টে গেছে। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গেছে কয়েকটি খণ্ডে আর বাংলা ভাষাভাষী জমিনও খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত। একদিকে ভারত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করে ফেলেছে, আমরাও স্বাধীনতার ছয় দশকে। এরকম একটা সময়ে এসে মধুসূদন উভয় দেশের কর্তৃপক্ষীয়ও স্তরে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। যদিও লেখালেখি পরিমণ্ডলের মানুষজন বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন দত্তকে আধুনিকতা প্রবর্তনের পথিকৃতের স্থান দিতে কার্পণ্য করেন না।  

তাতে কী? মধুসূদনকে কেন্দ্র করে লেখালেখির দুনিয়ার সঙ্গে রাজনীতি ও প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের হিসেবের গরমিলটা বড় বেশি। এই বাস্তবতা সীমান্তের ওপারে ভারতে এবং এপারে বাংলাদেশে একই রকম প্রকট। এর পেছনের কারণটা কী? মধুসূদনকে নিয়ে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ফায়দা লাভের সুযোগটা বড় বেশি কম বলেই কি? বাঙালির জাতিগত সামগ্রিক আত্মমর্যাদা তুলে ধরার জন্যে মধুসূদন অবশ্যম্ভাবী একটি নাম। এতে তো আর ধর্মীয় আর দলীয় উন্মাদনার পালে হাওয়া লাগে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার কুশীলবরা নিজ নিজ স্বার্থে পালে হাওয়া লাগাতে চান। এই রহস্যের ঘেরাটোপেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ মহাকবি মধুসূদন জন্মের ২০০ বছরে এসেও উদাসীনতার খপ্পরে।

মধুসূদন প্রতিভা কেমন ছিল? শৈশবে মধুসূদন রচিত ’কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি পাঠ্যপুস্তকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভের অধিকারী আমার মতো প্রতিটি বাঙালি সন্তান। এরপর মধুসূদনকে ঘিরে নানা গল্পের সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে থাকি। তার বেশিরভাগ গল্প হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ, বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে বিপদে সাহায্য লাভ– এরকম বিষয়কে কেন্দ্র করে।

তবে মধুসূদনকে উদ্ধৃত করা একটি বাক্য বহুল প্রচলিত: ’রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে টাকা কাউকে গুনে দেয় না’। আসলেই কি তাই? মধুসূদন নিজে অভাবে থেকেছেন, অনাহারে থেকেছেন। এরকম হীন অবস্থার মাঝেও যখন তার হাতে টাকা এসেছে, তিনি হিসাব করে খরচ করেননি। তার কাছে উপকার প্রার্থী হয়ে এসে কেউ নিরাশ হয়নি। লেনদেনের সময় পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করে লেনদেন করেছেন। কিন্তু কত টাকা বের করলেন, কত টাকাই বা দিলেন তা গুনে দেখতেন না।  টাকা দিয়েই হাঁটা শুরু করতেন তিনি।

তার জীবন ছিল নাটকীয় ঘটনায় ভরপুর। তিনি নিজে কারও সঙ্গে বিশ্বাস ভাঙেননি। কিন্তু তার সঙ্গে অনেক আত্মীয়-বন্ধু বিশ্বাস রক্ষা করেননি। যার মাশুল দিতে হয়েছে মধুসূদনকে জীবনের পরতে পরতে।

শৈশবে খুব প্রতিভাবান উজ্জ্বল এক শিক্ষার্থী হিসেবে জন্মভূমি যশোরের সাগরদাঁড়িতে সবার প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। মধুর কণ্ঠের অধিকারী মধুসূদন সঙ্গীদের  মাঝে অনেক গুণের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ছিলেন বন্ধুবৎসল। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হবার কারণে জাহ্নবী দেবীর  ব্যাপক প্রশ্রয় ও আহ্লাদ পেয়েছিলেন। আইনজ্ঞ বাবা রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতায় আইন পেশায় ব্যাপক পসার লাভ করেছিলেন। পরিবারের টাকা ও সম্পত্তির কমতি ছিল না। এসব কারণে মধুসূদনের বেপরোয়া বেহিসেবি জীবনযাপনের দিকে ধাবিত হতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

শৈশবে একবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রতিবেশীর খেঁজুর গাছে উঠেছেন রস চুরি করতে। গাছের মালিক টের পেয়ে গাছের নিচে এসে হাজির হয়েছেন। এরকম বিপদে তার সঙ্গীরা তাঁকে রেখে পালিয়ে গেছে। গাছে ওঠা শিশু মধুসূদন কান্না জুড়ে দিয়েছেন। গাছের মালিক মধুসূদনকে অভয় আর আদর দিয়ে গাছ থেকে নামিয়ে রস খেতে দিয়েছেন। মধুসূদন আজন্ম সৎ ছিলেন। শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দুঃখের সাগর পাড়ি দিয়েছেন একের পর এক।

তারুণ্যে তার মাঝে ইংরেজি ভাষা সাহিত্য এবং বিলেতি সাহেবিয়ানার প্রতি ঝোঁক পেয়ে বসে। তিনি ইংরেজ সাহেব হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যান। বিলেতি জীবনযাপন লাভের তারুণ্যদীপ্ত ক্ষেপাটে মনোভাব তাকে আচ্ছন্ন করে। ১৮৪০-এর দশকে তিনি উত্তরাধিকার হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। নামের আগে মাইকেল যোগ করে নিলেন। তিনি পরিবার পরিজন ছেড়ে যান, হিন্দু পরিমণ্ডল ত্যাগ করেন। হিন্দু কলেজ ছেড়ে খ্রিষ্টানদের বিশপস কলেজে ভর্তি হন।

ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করেন। গোপনে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসতেন যশোরে গিয়ে। মা অনেক কান্নাকাটি করতেন। বাবা সামাজিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেও মধুসূদনকে টাকা পাঠাতেন নিয়মিত। টাকাকড়ি পেতেন মায়ের কাছ থেকেও। ১৮৪০-এর দশকের শেষার্ধে ছুটে গেলেন মাদ্রাজে জাহাজে চেপে, কাউকে না জানিয়ে। পরিবারের সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  বিদেশ-বিভূঁইয়ে রেবেকা ম্যাকটাভিশ নামের খ্রিষ্টান শ্বেতাঙ্গী এক তরুণীকে বিয়ে করেন, ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত হন। শিক্ষকতাও করেন কয়েক বছর। ইংরেজি ভাষায় লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

তার মাদ্রাজবাসের সময় প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Captive Ladie  প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশ করতে গিয়ে ধারদেনার মুখে পতিত হন। ১৮৫০-এর দশকের প্রায় শেষাবধি রেবেকার সঙ্গে তার সন্তানের সংখ্যা চার। এর মধ্যে কিশোরী হেনরিয়েটার প্রেমে পড়েন আজন্ম ক্ষেপাটে এই কবি। তিনি মাদ্রাজে স্ত্রী সন্তান ছেড়ে কলকাতায় ফিরলেন। ততদিনে বাবা-মা আর বেঁচে নাই। পৈতৃক সম্পত্তিও হাতছাড়া প্রায়।

মাদ্রাজে থেকে তিনি মাতৃভাষা বাংলা প্রায় ভুলেই বসেছেন। ওখানে তিনি বাংলা ভাষার সংস্পর্শ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। শেষে তার বন্ধু গৌরদাস বসাকের উৎসাহ আর পরামর্শে বাংলায় লেখালেখি করতে উদ্যোগী হন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তার ভুলে যাওয়া মাতৃভাষা বাংলায় একের পর এক যুগান্তকারী আধুনিক সাহিত্যকর্ম উপহার দেওয়া শুরু করেন।

সব ঠিক ছিল। মধুসূদন লেখালেখিতে খ্যাতির শীর্ষে। চাকরি আর পারিবারিক সম্পত্তির আয়ে দিন ভালোই চলছিল। হঠাৎ খেয়াল চাপলো তিনি বিলেতে যাবেন। আজন্ম বোহেমিয়ান মনের অধিকারী বিরল এই প্রতিভার কোনও কিছুতেই ইচ্ছার পরাজয় নাই। ইচ্ছে হলো বিলেত যাবেন। ব্যারিস্টারি পড়বেন। উকিল হবেন। অনেক টাকার মালিক হবেন। পারিবারিক সম্পত্তি আত্মীয় আর বন্ধুর কাছে বন্দোবস্ত দিয়ে স্ত্রী হেনরিয়েটা ও দুই সন্তানের জন্যে প্রতিমাসে ১৫০ টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বিলেতের উদ্দেশে জাহাজে চেপে বসলেন। বিলেত পৌঁছে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়ে গেলেন। এর মধ্যে কলকাতায় তার তথাকথিত আত্মীয়-বন্ধুরা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। স্ত্রী সন্তান অভাব অনটনে পড়ে গেলেন। শেষতক উপায়ান্তর না দেখে স্ত্রী হেনরিয়েটা তার দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে উঠে বসলেন বিলেতের উদ্দেশে। উপোস থাকার হুমকিতে পড়া আর্থিক অনটনের খপ্পরের মাঝে হেনরিয়েটা স্বামী মধুসূদনের দরজায় গিয়ে হাজির।

বিলেতে একদিকে বর্ণবাদী আচরণের খপ্পর অন্যদিকে  ব্যয়বহুল জীবনযাত্রা মধুসূদনকে বিচলিত করলো। বিলেতের তুলনায় কম খরচে জীবন চালিয়ে নেবেন এই মর্মে ফরাসি দেশের ভার্সাই নগরীতে বাসা ভাড়া নিলেন।

অনটনের সাগরে স্ত্রী সন্তান চলে আসায় অভাবের তাড়না মহাসাগরে রূপ নিয়েছিল। মধুসূদনের জীবনের সঙ্গে দুটো সাগর জড়িয়ে ছিল। একটি ছিল ’দুঃখের সাগর’, অন্যটি ’দয়ার সাগর’। ’দয়ার সাগর’টির নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দুঃখের দরিয়ায় পড়ে দয়া আর মানবতার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে পত্র মারফত সাহায্যপ্রার্থী হলেন। দয়ার সাগর যিনি তিনি মুক্তহস্তে নিজের যাবতীয় সামর্থ্য দিয়ে মধুসূদনের জন্যে টাকা পাঠিয়েছেন, প্রয়োজনে ধারদেনা করেও টাকা পাঠাতেন। দয়ার সাগরের সহযোগিতায় ভার্সাইয়ে মধুসূদন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন এবং ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরতেও পেরেছিলেন।

বিলেত-ভার্সাই পর্বে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে কলকাতা ফিরেও নানা পর্বে তার অনটনে বিদ্যাসাগরকে পাশে পেয়েছেন। একটি গল্প চালু আছে, একবার এক মাতাল বিদ্যাসাগরের নিকট টাকা চেয়েছেন। বিদ্যাসাগর বলেছেন, ’আমি কোনও মাতালকে টাকা দেই না’ ।

মাতালের পাল্টা প্রশ্ন: ’আপনি যে মধুসূদনকে টাকা দেন। সেও তো মাতাল’।

বিদ্যাসাগরের ঝাঁজালো উত্তর: তুমি মধুসূদনের একটা  ’মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখে নিয়ে আসো।  তোমাকেও টাকা দেবো।

জীবনের শেষের দিকে মধুসূদন পাওনাদারদের চাপাচাপি ভুলে থাকতে মদ খেয়ে নেশার ঘোরে চলে যেতেন নিজের একটু নিস্তারের জন্যে।

তার বাড়ির সামনে বাসার নিচে পাওনাদাররা কোলাহল বাজিয়ে রাখতো আর ভেতরে মধুসূদন মদ খেয়ে এই কোলাহল থেকে একটু মুক্তির উপায় খুঁজতেন।

এরকম অবস্থার মধ্যে তার বাসায় চুলা জ্বালাবার মতো উপায়ান্তর থাকতো না অনেক সময়। তিনি মেধাবী ব্যারিস্টার। একবার মধুসূদনের কাছে এক বন্ধু মক্কেল নিয়ে এসেছেন আইনি সাহায্যের জন্যে। ওই মক্কেল ছিলেন মধুসূদনের বন্ধুর বাল্যবন্ধু। কাজ শেষে ওই মক্কেল মধুসূদনকে আইনি ফি দিতে চাচ্ছেন। মধুসূদন টাকা নিলেন না। বললেন টাকা দিতে হবে না। মক্কেলটি চলে যাওয়ার পর মধুসূদন তাঁর বন্ধুকে বললেন, তোমার কাছে কি কিছু টাকা হবে, আমার বাসায় কোনও বাজার নেই, আমার পকেটেও টাকা নেই। ওই মক্কেল তো তোমার বাল্যবন্ধু। তোমার বাল্যবন্ধুর কাছ থেকে আমি টাকা নিতে পারি না।

দুঃখের সাগরে বাস করা টালমাটাল নাটকীয়তায় ভরা বাঙলা সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তক বাংলা ভাষা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করেছেন। কলকাতার পাইকপাড়ার তৎকালীন রাজাদের অনুরোধে বিদেশি নাটক অনুবাদ করতে গিয়ে টের পেয়েছিলেন বাংলায় আদতে পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কোনও নাটক নেই। তিনি লিখলেন প্রথম নাটক ’শর্মিষ্ঠা’। এটি ছিল মহাভারতের দেবযানী-যযাতি কাহিনি অবলম্বনে। মধুসূদন বাংলা নাটকের জনক। তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। বাংলা ভাষায় তিনি চতুর্দশপদী কবিতার উদ্ভাবক। তিনি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক প্রহসনেরও প্রবর্তক। তিনি কালজয়ী দুটি প্রহসন লিখে গেছেন। তিনি অনুবাদেরও পথিকৃৎ। যিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া ইংরেজি, ইতালিয়ান, ফরাসি, তেলেগু, তামিল, জার্মান, গ্রিক, লাতিন'সহ আরও বারটি ভাষা জানতেন।

বাংলা সাহিত্যে পত্রাকার কাব্যরচনা প্রথম দেখা যায় মধুসূদনের ’বীরাঙ্গনা কাব্য’। ১৮৬২ সালে এই গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম নারীর মুখে ভাষা দিলেন, নারীর কণ্ঠে শক্তি দিলেন। সেই অর্থে নারীর অস্তিত্বের আধুনিক স্বীকৃতি মধুসূদনের হাতেই।  বীরাঙ্গনা কাব্যে ১১টি পত্ররূপী কবিতা নিয়ে রচিত। মধুসূদন তার কাব্যে নারীদের পুরাণ-পরিচিতির মূলে আঘাত করেছেন। তিনি মানবিক অনুভূতির আলোকে নারী-হৃদয়ের কথকতায় তুলে ধরেছেন। এই কাব্য নজর বুলাবার পর নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) রচিত ’সুলতানার স্বপ্ন’ সাহিত্যকর্মের কথা মনে পড়ে। একই সঙ্গে মনে প্রশ্ন জাগে রোকেয়া কি ’বীরাঙ্গনা কাব্য’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?

রামায়ণের কাহিনি নিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দে তিনি রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ’মেঘনাদবধ কাব্য’, বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য এটি। রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক, বীর যোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধাররূপে চিত্রিত করে মধুসূদন ভারতবর্ষের মানুষের চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানেন। এতে তিনি প্রকৃত সত্যের তালাশ ও দেশপ্রেমের নজির  স্থাপন করে গেছেন। মধুসূদন তার যাবতীয় লেখা কাব্য, মহাকাব্য, প্রবন্ধ, অনুবাদ, নাটক ও প্রহসন রচনায় প্রচলিত রীতি আর সংস্কার ভেঙে কলমে এঁকেছেন মানবতা, মায়া, মমতা আর বিদ্রোহের চিত্র। নারীর মুখে দিয়েছেন ভাষা। ভাষার মানবিক রূপ, রুচিশীল পরিশীলিত ও বিবেচনাসম্পন্ন ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব বিনির্মাণের পথিকৃৎ লেখক তিনি।

এরকম একটি প্রতিভাকে অস্বীকার কিংবা বাতিল করার জন্যে বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো মেধাবী লেখকরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। মধুসূদনের মৃত্যুর সাত দশকের অধিককাল পরে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) তার ’সাহিত্যচর্চা’ গ্রন্থে মধুসূদনকে নিয়ে চল্লিশ পাতার কাছাকাছি দীর্ঘ এক প্রবন্ধে তাকে বাতিল করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মধুসূদনের সামগ্রিক লেখা ধরে একটার পর একটা অজুহাত খুঁজেছেন হেয় করার জন্যে, কিংবা দুর্বলতার ছাপ মারতে চেয়েছেন মধুসূদনের কালজয়ী সব সাহিত্যকর্মে, প্রতিটি ধাপে তাকে বাতিল করে রবীন্দ্রনাথকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মধুসূদনের লেখালেখিকে অপাঠ্য হিসেবে ইঙ্গিত করার সাহস দেখিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু মধুসূদনকে এভাবে অবমূল্যায়ন করতে চেয়েছেন, ’ . . . মাইকেলের মহিমা বাংলা সাহিত্যের প্রসিদ্ধতম কিংবদন্তি, দুর্মরতম কুসংস্কার’।

রবীন্দ্রনাথ তার তারুণ্যে ২১ বছর বয়সে ১৮৮০-এর দশকের শুরুর দিকে একটি লেখায়  মধুসূদনকে নিন্দা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতো মহীরুহসম প্রতিভা বিষয়টি পরে পরিণত বয়সে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, নিজের ভুলটি টের পেয়েছিলেন। মধুসূদনকে নিন্দার ঠিক ২৫ বছর পরে এসে ১৯০৭-৮ সালের দিকে প্রকাশিত ’সাহিত্যসৃষ্টি’ প্রবন্ধে প্রায়শ্চিত্ত করলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, “মেঘনাদবধ কাব্যে, কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনাপ্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই। এ পরিবর্তন আত্মবিস্মৃত নহে। ইহার মধ্যে একটা বিদ্রোহ আছে। কবি পয়ারের বেড়ি ভাঙিয়াছেন এবং রাম-রাবণের সম্বন্ধে অনেক দিন হইতে আমাদের মনে যে একটা বাঁধাবাঁধি ভাব চলিয়া আসিয়াছে স্পর্ধাপূর্বক তাহারও শাসন ভাঙিয়াছেন।”

রবীন্দ্রনাথ তারুণ্যে মধুসূদনকে নিন্দা  করেছেন, পরিণত বয়সে ভুল সংশোধনের সুযোগটা কাজে লাগলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তরা মধুসূদনকে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন আমার মাথায় ঢুকে না।  ঈর্ষা আশ্রিত কোনও চেতন অবচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নাকি রাম-রাবণ কোনও জটিলতা তা আমি ভেবে পাই না। মোহিতলাল মজুমদার মধুসূদনকে নিয়ে 'কবি শ্রী মধুসূদন' নামে  আস্ত একটি বই লিখেছিলেন।  কিন্তু মধুসূদন প্রতিভার এবং সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের তাৎপর্যের গভীরতা পুরোটা তুলে ধরতে পেরেছেন কি?

তবে সবকিছু ছাপিয়ে মধুসূদন বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক স্থপতি। স্থপতির এই আসন তার চিরন্তন প্রাপ্য। মধুসূদন আধুনিক বাঙালি মনের রূপকার। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অগ্রদূত। তিনি আমাদের আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। তার প্রতি জন্মের দুইশত বছর উদযাপনে এবং প্রয়াণের দেড়শ’ বছর কেনই বা উদাসীনতার খপ্পরে পড়লো? ’আত্মঘাতী বাঙালি’ বুঝি একেই বলে।

মধুসূদনকে নিয়ে নির্মাণ করা যেত পূর্ণদৈর্ঘ্য একটি ছবি, ছবি ও কর্মের প্রদর্শনী হতে পারতো নিদেনপক্ষে ঢাকা, যশোর, কলকাতা, মাদ্রাজ, বিলেত এবং ভার্সাই নগরীতে। প্রযোজনা করা যেত তাঁর নাটকগুলো, তাঁর সাহিত্যকর্ম অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া যেত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য, নাট্যকলা এবং ভাষা বিভাগগুলো সভা সেমিনার আলোচনা বিতর্ক এবং সৃজনশীল কর্মসূচি নিতে পারতো, ডাক বিভাগ তার স্মরণে নতুন ডাকটিকিট প্রকাশ করতে পারতো।

এমন বাস্তবতায় বাংলা ভাষার একজন পাঠক হিসেবে হতাশ হবার পক্ষে আমি না। দুইশ’ বছরে মধুসূদনকে এই সময়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা উপেক্ষা করলেও হাজার বছর পরে হলেও মধুসূদনকে আবিষ্কার করতে হবে বাঙালি জাতিকে। তুলে ধরতে হবে। মধুসূদন বাঙালির মেঘে ঢাকা আকাশের একটি সূর্য। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পঙক্তি ধার করে বলতে চাই "মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে। হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে।" বাংলা ভাষা সাহিত্যের  অবিনশ্বর নাম,  'হারা শশীর হারা হাসি' মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

লেখক: বাঙালি-সুইডিশ কবি ও নাট্যকার; বোর্ড সদস্য, সুইডিশ রাইটার্স ইউনিয়ন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদানির দুই ইউনিটই চালু, আসছে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
আদানির দুই ইউনিটই চালু, আসছে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেতানিয়াহুর বিরোধের নতুন ইঙ্গিত
সেনাবাহিনীর সঙ্গে নেতানিয়াহুর বিরোধের নতুন ইঙ্গিত
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার
ইডেনের সেই নেত্রীর বিরুদ্ধে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফুয়াদের মামলা খারিজ
ইডেনের সেই নেত্রীর বিরুদ্ধে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফুয়াদের মামলা খারিজ
সর্বশেষসর্বাধিক